পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়: বঙ্গবন্ধুর আদরের সন্তান ‘হাচু’ এখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। একবার নয়, দুবার নয়, পর পর তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। সব মিলিয়ে চারবারের। তিনিই দেশ ও সরকারের একমাত্র চালিকাশক্তি। একমাত্র অভিভাবকও। মাটির কাছাকাছি থাকা অগণিত মানুষের তিনি অতি আপনজন। পরম বন্ধু। সকল আশার শেষে জ্বলজ্বলে আশার পিদিম। একমাত্র ভরসার স্থান ও আশ্রয়স্থল। তিনি জননেত্রী শেখ হাসিনা। যার তুলনা কেবল তিনি নিজেই।
শেখ হাসিনা চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন গণতান্ত্রিক পথে। দেশের মানুষ তাঁকে ভোট দিয়ে সরকার পরিচালনার সুযোগ দিয়েছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত বিরল। প্রতিবারই তিনি মেয়াদ শেষে যথাসময়ে নির্বাচনও দিয়েছেন। জনগণের ইচ্ছাকে সম্মান দেখিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তরও করেছেন ২০০১ সালে। যদিও সেখানে ষড়যন্ত্রের তথ্য এবং স্বার্থান্বেষী মহলের নোংরামির গন্ধ আবিষ্কৃত হয়েছে পরবর্তীকালে। অর্থাৎ, শেখ হাসিনাকে নির্বাচনে হারাতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যে কূটকৌশল নেয়া হয়েছিল তাও দিনে দিনে উদ্ঘাটিত হয়েছে। পৃথিবীর পরাক্রমশালী স্বৈরশাসকের মতো তিনি জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেননি। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন রাষ্ট্রের মালিক জনগণ এবং জনগণের ইচ্ছাই শেষ কথা। অর্থাৎ, পিতার মতো শেখ হাসিনারও রয়েছে উদার গণতন্ত্র চর্চার প্রতি গভীর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা।
এটাই কি শেখ হাসিনার দোষ যে তিনি দেশের জনগণকে একটু বেশি ভালবাসেন! এটাই কি শেখ হাসিনার অপরাধ যে তিনি জনগণের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল! এটাই কি শেখ হাসিনার অপরাধ যে তিনি গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি আস্থা হারান না! এসব কারণেই বোধ হয় দীর্ঘ ছয় বছর পরবাসের দুর্বিষহ সময় পার করে নিজ বাসভূমে ফিরে এলে তাকে আপন পিতৃগৃহে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এ কারণেই বোধ হয় পরিচ্ছন্ন রাজনীতির চর্চায় তাকে বার বার বাধাগ্রস্ত হতে হয়। জীবনের ওপর আঘাত এবং বার বার মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয়। এ জন্যই বোধহয় মিথ্যা ও বানোয়াট মামলার নাটক সাজিয়ে ভূঁইফোড় শাসকরা শেখ হাসিনাকে কারাগারে পাঠিয়ে যন্ত্রণা দিতেও দ্বিধা করে না। টেলিভিশনে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার ও হেনস্থা করার ধরন দেখে একজন প্রৌঢ় রিক্সাচালককে কাঁদতে দেখেছি। রিক্সাচালকের একটাই প্রশ্ন, বঙ্গবন্ধুর মেয়েকে এই ভাবে-? আমি প্রৌঢ় রিক্সাচালককে সান্ত¦না দিয়ে বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে যাদের অন্তর কাঁপেনি তারা শেখ হাসিনাকে আর কতটুকু সম্মান করবে। প্রৌঢ় রিক্সাচালককে আশ্বস্ত করতে বলেছিলাম যে, শেখ হাসিনাকে বেশিদিন কারাগারে আটকে রাখা যাবে না। সম্ভবও নয়। রিক্সাচালক এর পর চোখের জল মুছে যে শঙ্কার কথাটি বলল তা আতঙ্কিত হবার মতোই। যদি জেলের ভেতর খাবারে বিষ মেশায়। আমি তখন বাকস্তব্ধ। এই শঙ্কা আমার সত্যি বলতে কি আজও কাটেনি। একমাত্র রক্ষাকবচকে নিয়ে দুশ্চিন্তা পিছু ছাড়ে না।
শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়েছিলেন ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই। চাঁদাবাজি ও হত্যা মামলার চাজশীটসহ মোট মামলা হয়েছিল পনেরোটি। যে দু’জন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী গুলশান ও রমনা থানায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছিলেন, তারা শেখ হাসিনার আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন বলে শোনা গিয়েছিল। কেবল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই নন, শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য দেশব্যাপী সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমেছিল। বিভিন্ন পেশার ২৫ লাখ মানুষ শেখ হাসিনার মুক্তি দাবিতে গণস্বাক্ষর দিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকায় দেশের গণ্যমান্যরা কলাম লিখেছিলেন সাহস করে। ইউরোপ-অস্ট্রেলিয়া-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রকাশ্যে সরব হয়েছিলেন অসংখ্য প্রবাসী। নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগ এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। অবশেষে নানামুখী চাপে তখনকার ‘লোকে মানে না আপনি মোড়ল’র দল শেখ হাসিনাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। দিনটি ছিল ২০০৮ সালের ১১ জুন।
এই ঘটনার আগে ২০০৭ সালের মার্চ মাসে শারীরিক চিকিৎসা এবং পারিবারিক কারণে তিনি বিদেশে গেলে শাসকরা সিদ্ধান্ত নেয় শেখ হাসিনাকে আর দেশে ফিরতে দেয়া হবে না। কিন্তু সকল পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিয়ে শাসকের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করে শেখ হাসিনা দেশে ফিরলেন মে মাসের সাত তারিখে। একাশির সতেরোই মে’র মতো সেদিনও সকল বাধা উপেক্ষা করে লাখো মানুষ তাঁকে গণঅভ্যর্থনা জানিয়েছিল। এটাই হলো শেখ হাসিনার রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও সাহসী মনোবল, যা তাঁকে এনে দিয়েছে সমানভাবে শত্রু-মিত্রের কাছ থেকে সম্ভ্রম এবং সম্মান।
এখানেই সব কিছু শেষ নয়। টালমাটাল আওয়ামী লীগের প্রধান কা-ারি হয়ে একাশি সালে দেশে ফিরে আসার পর থেকে ২০০৭ সালে কারাগারে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় ছাব্বিশ বছরে কতবার, কতভাবে যে তাঁর জীবননাশের চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র হয়েছে, তার বর্ণনা দিতে সাত কা- রামায়ণ লেখা হয়ে যাবে। সে ‘অমর কাব্য’ তারাই লিখুক যাদের কিছুটা হলেও দেনা শুধবার দায় আছে।
কিন্তু মাঝে মাঝেই একটা প্রশ্ন আমাকে এক ভীতিকর গহ্বরে ফেলে দেয়। যদি শত্রুরা সফল হতো তবে আমাদের কি অবস্থা হতো! বাংলাদেশের অবস্থা আজ কোথায় থাকত। বাংলাদেশ আদৌ কি এখনকার বাংলাদেশের মতো ঝকমকে থাকত? এ দেশের মানুষ কি হাস্যোজ্জ্বল হতে পারত। প্রবৃদ্ধির হার কোন্ তলানিতে গিয়ে ঠেকত। এত রফতানি, এত রেমিট্যান্স, এত উন্নয়ন কি স্বপ্নেও ভাবা যেত। দেশে-বিদেশে যে সাফল্যের সোনার তরীতে ভাসছে আজ বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে, তা তো অধরাই থেকে যেত। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের মতো একটা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পর্যবসিত হতো বাংলাদেশ। যার চেহারা আমরা দেখেছি পঁচাত্তরপরবর্তী দীর্ঘ সময় ধরে। দেশ ও সমাজ থেকে সম্প্রীতি শব্দটি উধাও হয়ে যেত অনেক আগেই, যদি না শেখ হাসিনা অনড়, অটল এবং ঐতিহ্যিক আদর্শের প্রতি ঋজু না হতেন। সব ধর্ম এবং নানা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সমন্বয়ে বর্ণময় ঔজ্জল্য কোন্ কালে ম্লান ও ফিকে হয়ে যেত আমাদের সোনার বাংলায়। এসব ভাবলে আমি অস্তিত্বহীন বোধের নিকষ অন্ধকারে বিলীন হতে থাকি। এক মহাভীতিকর অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করতে থাকে। তবে সেটা ক্ষণস্থায়ী। কারণ, শেখ হাসিনার মতো এক উদার অভ্যুদয়ের নেত্রী রয়েছেন বাংলা ও বাঙালীর কা-ারি হিসেবে, যার স্পর্শে সকল কাঁটা ধন্য হয়ে ফোটে বর্ণিল ও সুগন্ধি পুষ্প। সফল বাংলাদেশের কা-ারি তিনি, সাধারণে অসাধারণ।
বর্তমানে যখন পৃথিবীর গভীর গভীতর অসুখ, বাংলাদেশও ধুঁকছে এক অচেনা ও অশরীরী শত্রুর আক্রমণে, তখন সকল দায়িত্ব নিজ কাঁধে নিয়ে শেখ হাসিনা একাই লড়ছেন। তিনিই দিচ্ছেন সকল নির্দেশনা। আর্থিক প্রণোদনা, দরিদ্র ও তৃণমূল মানুষের জন্য অর্থ সহযোগিতা, চিকিৎসা সেবা, সামাজিক সুরক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তাÑসবক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্তের ত্বরিত বাস্তবায়ন সবই সম্ভব হচ্ছে শুধু নেতৃত্বের সুদক্ষতায়। দেশের সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি বিশ্ব ও আঞ্চলিক সঙ্কট মোকাবেলায় তিনি যেভাবে, যতটুকু ভূমিকা রাখছেন তার প্রশংসা করেছেন বিশ্ব নেত্ববৃন্দ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও গণমাধ্যমগুলোও। এছাড়া একাধিকবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ ফোরামগুলোকে তিনি যেভাবে নিজ অবস্থান এবং সফল বাংলাদেশকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছেন, তারও প্রশংসা শুনেছি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সপ্রশংস মন্তব্য থেকে যা প্রতিফলিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমেও। নানা দুর্যোগে বড়-ছোট দেশের জন্য শেখ হাসিনা যেভাবে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন, তা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান। কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাঁর সহজিয়া ভঙ্গির পদক্ষেপে দূর হয়েছে অনেক জটিল সমস্যা। তিনি দূরকে নিকট এবং পরকে আপন করে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন নিজ প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতায়। কিন্তু কোথাও তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সম্মানকে খাটো অথবা নতজানু নীতি গ্রহণ করেননি। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে যেমন সবখানে সম্মানিত হয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশকেও করেছেন গৌরবান্বিত। বিশ্বমাঝে বাংলাদেশের পরিচিতি এখন শেখ হাসিনার পরিচয়ে, এ কথা বললে খুব একটুও বাড়াবাড়ি হবে না। তবে কট্টর বিরোধীরা, যারা যুক্তিহীন সমালোচনার স্থায়ী বন্দোবস্ত নিয়েছেন, তাদের মুখ বন্ধ করবে কে? কেউ কেউ তো কিছু না বুঝেই ২০০৭ সালের ১৬ জুলাইয়ে মিষ্টি বিলিয়েছিলেন শেখ হাসিনা কারাবন্দী হবার পর। দেশের জনগণ এর সচিত্র প্রতিবেদন দেখেছে টেলিভিশন এবং খবরের কাগজে। এক/এগারো পরবর্তীকালে রাজনীতিক, কতিপয় সংবাদকর্মী ও মিডিয়া এবং সুবিধাভোগী সুশীলের দল একটা জেনারেল পারসেপশন সৃষ্টি করেছে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ তত্ত্বের ধুয়া তুলে। মূলত এটা ছিল মাইনাস ওয়ান অর্থাৎ মাইনাস শেখ হাসিনা এবং মাইনাস আওয়ামী লীগ ফর্মুলার বাস্তবায়ন। মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনাকে যখন বন্দী করা হয় তখন কিন্তু খালেদা জিয়া বহাল তবিয়তে। ১১ জুন শেখ হাসিনা মুক্ত হবার প্রায় আড়াই মাস পরে খালেদা জিয়া গ্রেফতার হয়েছিলেন। কেবল এই কারণেই মাইনাস টু ফর্মুলার উদ্ভাবন। দেশের সচেতন মানুষ এদিনে যা বোঝার বুঝে গেছেন এবং তার প্রতিফলন দেখা গেছে জাতীয় নির্বাচনে। জনগণের রায়ে শেখ হাসিনা বার বার প্লাস আর খালেদা জিয়া মাইনাস।
তবু শঙ্কা কাটে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্যে সবাই খুশি মনে হাসবে, এটা মানতে মন শতভাগ সায় দেয় না। দেশের গ-ি পেরিয়ে বিশ্বমাঝে শেখ হাসিনা প্রশংসিত হবেন আর তাতে কারও গা জ্বালা করবে না, এটা কি হয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনে যেমন তেমনি শেখ হাসিনার জীবনেও ষড়যন্ত্রের অশরীরী ছায়া পিছু ছাড়ে না। এই যে ভয়াবহতম এক সঙ্কট পার করতে তিনি জীবনপাত করছেন দেশের বিপন্ন মানুষের জন্য, সেখানে আশপাশের সব তার এক সুরে বা সমতালে বাজছে কি? মনে হয় না। তিনি যেভাবে সব ঠিক করতে চাচ্ছেন, সেভাবে বোধহয় সব ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। তিনি যেভাবে সকল কিছু জানতে চান, সেভাবে বোধহয় জানতে পারেন না। তা ছাড়া ঘোলা জলে মাছ শিকারের কৌশল এখন অনেকেই শিখে গেছে। তারা নিজেরাও গভীর জলের মাছ।
সব শেষে শেখ হাসিনার হাতেই প্রজ্বলিত মঙ্গলপ্রদীপ দেখতে এবং আস্থা রাখতে চাই। যে মঙ্গলদীপের আলোয় কেটে যাবে বিপন্ন মানুষের সঙ্কট এবং পৃথিবীর গভীরতর অসুখ।