প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে মাত্র কয়েক বছরেই শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন তিনি। শুধু ব্যবসায়ীদের ‘ফিটিং’ দিয়েই প্রতারণার মাধ্যমে নামে-বেনামে হয়েছেন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। সবাই তাকে চেনেন ‘ফিটিং মনির’ হিসেবেই। লাভজনক ব্যবসার প্রলোভন দেখিয়ে ব্যবসায়িক পার্টনার নিয়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎই তার প্রধান কৌশল। প্রতিটি ব্যবসা থেকে নিজে আঙুল ফুলে ‘কলাগাছ’ হলেও অংশীদারদের সর্বস্বান্ত করেছেন তিনি। একসময় সুযোগ বুঝে যৌথ ব্যবসা বা শিল্পকারখানায় পার্টনারদের অংশ নিজের নামেও করে নিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রতারণা করে গত এক যুগে তিনি তিনটি জুট মিলসহ অন্তত সাতটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে; হয়েছে একাধিক মামলা। তার পুরো নাম মৃধা মনিরুজ্জামান। যুবদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহসভাপতি হলেও এ সরকারের আমলে তিনি এতদিন বহাল তবিয়তে রয়েছেন। দুদকের মামলায় মাঝে জেলে গেলেও পরে বেরিয়ে এসে জোরেশোরে শুরু করেছেন প্রতারণা-জালিয়াতিসহ পুরোনো কারবার। সম্প্রতি এক অংশীদার তার বিরুদ্ধে প্রায় ৪৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও হত্যার হুমকির অভিযোগ এনে রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করেছেন, যার নম্বর ১১৫৫(৫)/২। মামলাটি এখন সিআইডিতে রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ করে মৃধা মনিরুজ্জামান গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলছেন। তার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের সহিংস আন্দোলনে অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ নিয়ে কাজ করছে সরকারের একাধিক সংস্থা।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একসময় দপ্তরির কাজ করতেন মৃধা মনিরুজ্জামানের বাবা আবদুল হালিম মৃধা। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসেবে উত্তরাধিকারের তেমন কিছুই পাননি তিনি। বিএনপি পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মূলত ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে ভাগ্য বদলের নেশায় পেয়ে বসে মনিরুজ্জামানকে। ওই সময় তিনি যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। এই পদ ব্যবহার করেই অবৈধভাবে বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়ে যান।
মামলার বিবরণী এবং বিভিন্ন সংস্থায় মনিরুজ্জামানের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগ থেকে জানা যায়, শুরুতে কয়েকজন বন্ধুকে পার্টনার করে মতিঝিলের আরামবাগে অনিন্দ্য প্রিন্টার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে নানাভাবে অর্থ তছরুপ শুরু করেন মৃধা মনিরুজ্জামান। এ কারণে তার পার্টনাররা নিজেদের গুটিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই মনিরুজ্জামান তার অবৈধ টাকা দিয়ে প্রাইড প্যাকার্স, দেশ পেপার অ্যান্ড প্যাকেজিং, প্রাইড জুট মিল ইন্ডাস্ট্রিজ ও অ্যাডভান্স সোয়েটার নামে আরও চারটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে যান। প্রতারণার কৌশল হিসেবে সেসব প্রতিষ্ঠানেও তিন-চারজন বিত্তশালীকে পার্টনার নেন। প্রতারণা ও অনিয়মের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান থেকেও বিপুল অঙ্কের অর্থ বাগিয়ে নেন। অবশেষে পার্টনারদের কাঁধে ব্যাংকের দায়দেনা রেখে মৃধা মনিরুজ্জামান কেটে পড়েন। তবে প্রাইড জুট মিল নিজের কবজায় রাখেন। জোট সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে গা-ঢাকা দেন তিনি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে শুরুতে বেশ কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও পরে নতুন করে শুরু করেন প্রতারণা। আবারও তিন-চারজন পার্টনার নিয়ে গোল্ডেন জুট মিল গড়ে তোলেন। এবারও পার্টনাররা অন্ধ বিশ্বাসে মিল পরিচালনার দায়িত্ব দেন তার ওপর। প্রথমে ওই জুট মিলে মৃধা মনিরুজ্জামানের মাত্র ১০ শতাংশ শেয়ার থাকলেও চাতুরতার মাধ্যমে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হন তিনি। এটিকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেন মৃধা মনিরুজ্জামান। নিম্নমানের পাট বেশি দামে কেনাসহ নানাভাবে প্রতারণা ও অনিয়মের মাধ্যমে এবারও বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। কিন্তু প্রতারণার কৌশল হিসেবে দিনের পর দিন জুট মিলকে লোকসান দেখান মনিরুজ্জামান। এর মাধ্যমে পার্টনারদের মধ্যে কৃত্রিম হতাশা সৃষ্টি করেন তিনি। এই কৌশলে পার্টনারদের কাছ থেকে ৪০ শতাংশ শেয়ার নিজের এবং পিজা ইনের কর্মচারী ছেলে মেহেদী জামান সনেটের নামে কিনে নেন। বর্তমানে প্রাইড ও গোল্ডেন জুট মিলে মনিরুজ্জামান ও তার ছেলে সনেটের নামে ৫০ শতাংশ করে মালিকানা রয়েছে। এরই মধ্যে ক’বছর আগে জনৈক সৌদিপ্রবাসী এক ব্যবসায়ীকে জুট মিলে বিনিয়োগে বিশাল সম্ভাবনার কথা বলে প্রধান অংশীদার করে দাহমাশি জুট ইন্ডাস্ট্রিজ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ নেন তিনি, যা আগের দুটি জুট মিলের চেয়ে তিন-চার গুণ বেশি উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। এই জুট মিলে কোনো অর্থ বিনিয়োগ না করে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়ে কয়েক বছরে প্রায় শতকোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, মনিরুজ্জামানের ছেলে সনেট পিজা ইনে মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী ছিলেন। এখন কোটি টাকার ব্র্যান্ড নিউ ওডি গাড়ির মালিক। মনিরুজ্জামান নিজে ব্র্যান্ড নিউ ল্যান্ডক্রুজার গাড়িতে ঘোরেন।
কাঁচা পাটের ব্যবসায়ও মনিরুজ্জামানের নামে-বেনামে রয়েছে কয়েকশ কোটি টাকার বিনিয়োগ। সাম্প্রতিক সময়ে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পাটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে দিয়ে বিপুল অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নিয়েছেন বলেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ। নিজের ছেলের নামে এমএস জুটসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের নামে মোট ছয়টি প্রতিষ্ঠান খুলে পাট সরবরাহ করেন তিনি। এ ছাড়া কাঁচা পাট ও পাট থেকে উৎপাদিত সুতা চোরাপথে ভারতে পাচারের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
সিআইডিতে মামলা :সবশেষ দাহমাশি জুট মিলে কোনো বিনিয়োগ না করেও অপারেশনাল দায়িত্ব পালনের কথা বলে কৌশলে ৪৬ শতাংশের মালিক বনে যান মৃধা মনিরুজ্জামান ও তার ছেলে মেহেদী জামান সনেট। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, দাহমাশি জুট মিল প্রতিষ্ঠাকালে জমি কেনা থেকে মেশিনারিজ আমদানি, অবকাঠামো তৈরিসহ সব ক্ষেত্রেই জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেন মৃধা মনিরুজ্জামান। শুরুতে পার্টনাররা টের না পেলেও ২০১৯ সালের ৩০ আগস্ট দুদকের মামলায় জেলে যাওয়ার পর তার অনিয়ম, জালিয়াতি ও প্রতারণার বিষয়গুলো একে একে প্রকাশ পায়। দাহমাশি জুট মিল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই মৃধা মনিরুজ্জামান, তার ছেলে সনেট ও ভাই বাবলুসহ আত্মীয়স্বজন ফুলেফেঁপে কলাগাছ হতে থাকেন। তারা এ তিনটি কারখানায় বড় পাট সরবরাহকারী। ছয়টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান খুলে পাট সরবরাহের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন তারা। বেশি দাম নেওয়া, কম দামের নিম্নমানের পাট দিয়ে বাড়তি দাম দেখিয়ে ওই টাকা হাতিয়ে নেওয়া, কোম্পানির টাকায় কেনা পাট দিয়ে উৎপাদিত সুতা স্থানীয় বাজারে ও চোরাপথে ভারতে পাচার করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেও বিপুল অঙ্কের মালিক হয়েছেন মনিরুজ্জামান। এ ছাড়া ভালো সুতা নষ্ট দেখিয়েও কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। দাহমাশি গ্রুপের অংশীদাররা নিরপেক্ষ অডিট কোম্পানিকে দিয়ে অডিট করালে এই জুট মিল থেকে মনিরুজ্জামান ৪৫ কোটি ৯২ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে প্রমাণ মিলেছে। এ ব্যাপারে বনানী থানায় দায়ের করা মামলা নিয়ে কাজ করছে সিআইডি। তবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও বরাবরের মতো অর্থের জোরে সবকিছু ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন তিনি। তাই এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন বলে অভিযোগ। অভিযোগ সম্পর্কে মনিরুজ্জামানের বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করে পাওয়া যায়নি। তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ। ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, মামলার কারণে তিনি এখন গা-ঢাকা দিয়ে আছেন।
পাট সরবরাহকারীদের টাকা আত্মসাৎ :অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ৩০ জন পাট সরবরাহকারীর অন্তত ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন মৃধা মনিরুজ্জামান। আশরাফুল ইসলাম নামের এক পাট সরবরাহকারী অভিযোগ করেন, দিনের পর দিন পাট নিলেও মনিরুজ্জামান তাদের পাটের দাম পরিশোধ করেননি। কিন্তু নিজের সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে কম দামের পাট বেশি দামে কেনা দেখিয়ে মিল থেকে ঠিকই টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। বকেয়া টাকার দাবিতে তারা গোল্ডেন জুট মিল ঘেরাও করেও কাজ না হওয়ায় বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েছেন। সূত্র: সমকাল