ধর্ম ডেস্ক : আল্লাহ তাআলা জালেমদের তাওবাহ কবুল করেন না। আবার জুলুমের প্রতিদান হলো- আল্লাহর, ফেরেশতাদের এবং সব মানুষের অভিশাপ। জালেম ও জুলুমের পরিণতি কি এখানেই শেষ? এসব অত্যাচারিরা কি তাদের জুলুম থেকে ফিরে আসার সুযোগ পাবে? এ সম্পর্কে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা কী?
কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহ তাআলা জালেম ও জুলুমের এসব পরিণতি ও প্রতিদানের কথা যেমন তুলে ধরেছেন আবার তা থেকে ফিরে আসার বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাষায় উল্লেখ করেছেন এভাবে-
> کَیۡفَ یَهۡدِی اللّٰهُ قَوۡمًا کَفَرُوۡا بَعۡدَ اِیۡمَانِهِمۡ وَ شَهِدُوۡۤا اَنَّ الرَّسُوۡلَ حَقٌّ وَّ جَآءَهُمُ الۡبَیِّنٰتُ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ
কেমন করে আল্লাহ সে কওমকে হেদায়াত দেবেন, যারা ঈমান আনার পর কুফরি করেছে, আর তারা সাক্ষ্য দিয়েছে যে, নিশ্চয়ই রাসুল সত্য এবং তাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ এসেছে। আর আল্লাহ জালিম কওমকে হেদায়াত দেন না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৬)
> اُولٰٓئِکَ جَزَآؤُهُمۡ اَنَّ عَلَیۡهِمۡ لَعۡنَۃَ اللّٰهِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ وَ النَّاسِ اَجۡمَعِیۡنَ
‘এরাই তারা, যাদের প্রতিদান হলো- নিশ্চয়ই তাদের উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লানত।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৭)
> خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ۚ لَا یُخَفَّفُ عَنۡهُمُ الۡعَذَابُ وَ لَا هُمۡ یُنۡظَرُوۡنَ
‘তারা তাতে (আল্লাহর অভিশাপে) স্থায়ী হবে; তাদের থেকে আজাব শিথিল করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেওয়া হবে না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৮)
> اِلَّا الَّذِیۡنَ تَابُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِکَ وَ اَصۡلَحُوۡا ۟ فَاِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
‘কিন্তু তারা ছাড়া যারা এরপর (জুলুমের বিষয়টি বুঝার পর) তাওবা করেছে এবং (নিজেদের ভুল) শুধরে নিয়েছে। তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৯)
> اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بَعۡدَ اِیۡمَانِهِمۡ ثُمَّ ازۡدَادُوۡا کُفۡرًا لَّنۡ تُقۡبَلَ تَوۡبَتُهُمۡ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الضَّآلُّوۡنَ
‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করেছে ঈমান আনার পর, তারপর তারা কুফরীতে বেড়ে গিয়েছে, তাদের তাওবা কখনো কবুল করা হবে না। আর তারাই পথভ্রষ্ট।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯০)
আল্লাহ প্রথম আয়াতে একটি সুস্পষ্ট করেছেন, যারা একবার আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে সত্য বলে মেনে নিয়েছে এরপর আবার তা অস্বীকার করেছে; তারাই প্রকৃত জালেম। তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তাওবাহ করে ফিরে আসলে ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ রয়েছে। একটি ঘটনার প্রেক্ষিতে পরবর্তী আয়াতগুলো নাজিল হয়। সে ঘটনাটি কী?
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, আনসারদের এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পর (আবার ইসলাম ত্যাগ করে) মুরতাদ হয়ে যায় এবং মুশরিকদের সঙ্গে মিশে যায়। পরে সে লজ্জিত হয় এবং তার স্বজাতির কাছে বলে পাঠায় যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা কর আমার কি কোনো তাওবাহ (ফিরে আসার সুযোগ) আছে? তার স্বজাতির লোকেরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে এসে জিজ্ঞাসা করলেন যে, অমুক লজ্জিত হয়েছে এবং জানতে চেয়েছে যে, তার জন্য তাওবাহ আছে কি না? তখন এ আয়াতসহ পরবর্তী চারটি আয়াত নাজিল হয়। পরে সে (তাওবাহ করে আবার ইসলামে) ফিরে আসে এবং পুনরায় ইসলামে প্রবেশ করে।’ (নাসাঈ, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে হিব্বান)
এ আয়াত নাজিল সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো- আহলে কিতাব তথা ইয়াহুদি পণ্ডিতরা উদ্দেশ্য। তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে তাদের গ্রন্থে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিল যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সত্য নবি। তিনি আগের নবি-রাসুলদের একই মিশন ও শিক্ষা নিয়েই পৃথিবীতে এসেছেন। এসব জানার পর এবং সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও শুধু বিদ্বেষ, হঠধর্মিতা ও সত্যের সঙ্গে দুশমনি করেই তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অস্বীকার করেছিল। তারা শত শত বছর ধরেই এ জুলুম করে আসছিল।
উল্লেখিত আয়াতগুলো আরও সুস্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সর্বশেষ রেসালাত ও নবুয়তের স্বীকৃতি থেকে বিরত থাকা ব্যক্তিরাই জালেম। ইসলামের প্রতি এটি মারাত্মক জুলুম। যার ফলে যারা এ কাজে জড়িত; তাদের পরিণাম ও প্রতিদান কী হবে তা পরবর্তী আয়াতে ওঠে এসেছে এভাবে-
> اُولٰٓئِکَ جَزَآؤُهُمۡ اَنَّ عَلَیۡهِمۡ لَعۡنَۃَ اللّٰهِ وَ الۡمَلٰٓئِکَۃِ وَ النَّاسِ اَجۡمَعِیۡنَ
‘এরাই তারা, যাদের প্রতিদান হলো- নিশ্চয়ই তাদের উপর আল্লাহর, ফেরেশতাদের ও সকল মানুষের লানত।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৭)
> خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ۚ لَا یُخَفَّفُ عَنۡهُمُ الۡعَذَابُ وَ لَا هُمۡ یُنۡظَرُوۡنَ
‘তারা তাতে (আল্লাহর অভিশাপে) স্থায়ী হবে; তাদের থেকে আজাব শিথিল করা হবে না এবং তাদেরকে অবকাশও দেওয়া হবে না।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৮)
তাদের কেউ যদি নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আবার সঠিক পথে ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে চায়; তবে তাদের এ থেকে অবকাশেরও সুযোগ রয়েছে। ভুল বুঝতে পেরে তাওবাহ করলেই আল্লাহ তাআলা তাদের ক্ষমা করে সঠিক পথ দেখাবেন। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-
> اِلَّا الَّذِیۡنَ تَابُوۡا مِنۡۢ بَعۡدِ ذٰلِکَ وَ اَصۡلَحُوۡا ۟ فَاِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
‘কিন্তু তারা ছাড়া যারা এরপর (জুলুমের বিষয়টি বুঝার পর) তাওবা করেছে এবং (নিজেদের ভুল) শুধরে নিয়েছে। তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮৯)
যাদের ক্ষমা নেই এবং তাওবাহও নেই
আবার কিছু অস্বীকারকারীকে আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন; যার বর্ণনাও আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারিমে তুলে ধরেছেন এভাবে-
> اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بَعۡدَ اِیۡمَانِهِمۡ ثُمَّ ازۡدَادُوۡا کُفۡرًا لَّنۡ تُقۡبَلَ تَوۡبَتُهُمۡ ۚ وَ اُولٰٓئِکَ هُمُ الضَّآلُّوۡنَ
‘নিশ্চয়ই যারা কুফরি করেছে ঈমান আনার পর, তারপর তারা কুফরীতে বেড়ে গিয়েছে, তাদের তাওবা কখনো কবুল করা হবে না। আর তারাই পথভ্রষ্ট।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯০)
অর্থাৎ কেউ যদি ইসলাম ও রেসালাতে বিশ্বাস স্থাপনের পর পুনরায় কুফরি করে। শুধু অস্বীকারেই করে না বরং কার্যকরীভাবে ইসলাম এবং রেসালাতের বিরোধিতা করার পাশাপাশি ইসলামের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। আল্লাহর পথে চলা থেকে বিরত রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করে। ইসলামের প্রতি সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তি প্রচার করে বেড়ায়। মানুষের মনের মধ্যে দ্বিধা সৃষ্টি করে। মানুষ যাতে কোনোভাবেই সঠিক পথে চলার সুযোগ না পায় এ ব্যাপারে কার্যক্রম অব্যাহত রাখে; আল্লাহ তাআলা তাদের কখনো ক্ষমা করবেন না। আর তাদের তাওবাহও কবুল হবে না।
সর্বোপরি কথা হলো
যারা নবুয়ত ও রেসালাতের বিরোধিকা করে তারাই সবচেয়ে বড় জালেম। তাদের কোনো ক্ষমা নেই। তারা হচ্ছে আল্লাহর দুশমন ইয়াহুদি সম্প্রদায়। তারা আসমানি গ্রন্থ ইঞ্জিল ও হজরত ঈসা আলাইহিস সালামকে অস্বীকার করেছে। তারপর তারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও কোরআনকে অস্বীকার করেছে। (তাবারি)
সুতরাং তাদের জন্যই অপেক্ষা করছে ভয়াবহ পরিণতি। তাদের তাওবাহ কবুল করা হবে না। তাদের তাওবাহ কবুল না হওয়ার কারণ হচ্ছে-
তারা কোনো কোনো গুনাহ থেকে তাওবাহ করলেও মূল গুনাহ কুফরি থেকে তাওবাহ করে না। সুতরাং তাদের তাওবাহ কিভাবে কবুল হবে?
এটা হলো সেই তওবাহ যা মৃত্যুর সময় করা হয়। যদিও আল্লাহ তাআলা তাওবাহ কবুল করে থাকেন। কিন্তু এই আয়াতে যে তওবাহর কথা বলা হয়েছে, তাহলো একেবারে শেষ মুহূর্তের তওবাহ; যা কবুল হবে না। যেভাবে অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন-
وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ
‘আর এমন লোকদের জন্য কোনো তওবাহ নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে; এমন কি যখন তাদের কারো কাছে মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়ে যায়, তখন বলে, আমি এখন তওবাহ করছি।’
হাদিসে পাকে এসেছে, ‘অবশ্যই আল্লাহ বান্দার তওবাহ মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত কবুল করে থাকেন।’ (মুসনাদ আহমাদ-তিরমিযী) অর্থাৎ, জাকান্দানীর সময়ের তওবাহ কবুল হয় না।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে ইসলাম ও রেসালাতের বিশ্বাস স্থাপন করার তাওফিক দান করুন। তাওহিদ ও রেসালাতের প্রতি অবিশ্বাসের জুলুম থেকে মুক্ত থাকার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর কাছে এসব জালেম ও জুলুম থেকে মুক্ত থাকতে বেশি বেশি তাওবাহ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।