লিগ্যাসি ফুটওয়ার ও আলিফ ইন্ড্রাস্ট্রিজ শেয়ার দরে সমানে কারসাজি চলছে। বছরের পর বছর ধরে খারাপ ইপিএস ও নামমাত্র ডিভিডেন্ট দেওয়া এ দুর্বল কম মৌলভিত্তির কোম্পানি দুটি ছক কষে দাম বাড়াচ্ছে শেয়ারের। এমন অভিযোগই তুলেছেন একাধিক বিনিয়োগকারীসহ বাজারসংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, উল্লেখযোগ্য কোনো মেরিট না থাকলেও দুর্বল এ প্রতিষ্ঠান দুটির শেয়ারের দাম মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এর আড়ালে কারসাজি করে যাচ্ছেন, সে প্রশ্ন তুলেছেন খোঁদ বিনিয়োগকারীসহ বাজার সংশ্লিষ্টরা। জড়িত কারা- উঠেছে সে প্রশ্নও।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, খোদ মালিক পক্ষ ও ‘এস’ আদ্যাক্ষরের একজন গ্যাম্বলার, যিনি দীর্ঘদিন ধরে কোনঠাসা হয়ে ছিলেন, কারসাজির দায়ে বিভিন্ন সময়ে গুনেছেন জরিমানা- তিনি আবার তেড়ে-ফুড়ে তৎপর হয়ে উঠেছেন বাজারে। কারসাজির ছক নিয়েই কোমরবেধে নেমেছেন পুঁজিবাজারের অর্থ হাতাতে। ইতোমধ্যেই তিনি বেশকিছু দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দরে কারসাজি করে অতি উচ্চ দর তুলেছেন। এর মধ্য দিয়ে ওই গ্যাম্বলার নিজে আর্থিক লাভবান হয়েছেন, আর এরই মধ্যে তার ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীরা। ওই গ্যাম্বলার নামে বেনামে বিও একাউন্ট খুলে বিশেষ ছক নিয়ে মাঠে রয়েছেন।
অনুসন্ধান বলছে, এ ধরনের কতিপয় গ্যাম্বলার ও মালিকপক্ষ যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে কম মৌলভিত্তির দুর্বল কোম্পানিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ করছে। টানছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও। এ কারণে কম মৌলভিত্তির শেয়ারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ তুলনামুলক বেশি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। আকৃষ্ট করা হচ্ছে বিভিন্ন কৌশলে। আর ভালো ক্যাশ ডিভিডেন্ট (লভ্যাংশ) দেওয়া মৌলভিত্তির প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা তেমন একটা যাচ্ছেন না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য-উপাত্ত বলছে, লিগ্যাছি ফুটওয়্যার শেয়ার বাজারে এসেছে ২০১৭ সালে সালে। ২০২১ সাল ও ২০২২ সালের কোনো ডিভিডেন্ট কোম্পানিটি দিতে পারেনি। আর ২০২০ সালের লাভের ওপর ২০২১ সালে মাত্র ১% ক্যাশ ডিভিডেন্ট দিয়েছে বলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে। আর ২০১৯ সালে দিয়েছে ৫% ক্যাশ ডিভিডেন্ট। গত ৭ মে এর শেয়ার দর ছিল ৬৫.৯০ টাকা। যা ৪ জুন ১০৬ টাকা ১০ পয়সা এবং বুধবার ১১০ টাকা ৬০ পয়সায় পৌঁছেছে।
একইভাবে আলিফ ইন্ডান্ট্রিজের শেয়ার ২৫ মে ছিল ৫৩ টাকা ৪০ পয়সা। তবে ৭ জুন বুধবার এর দর ওঠে ৮০ টাকা ২০ পয়সা। শেয়ার বাজারে এসে ২০১৭ সাল থেকে ক্যাশ ডিভিডেন্ট দিচ্ছে এ কোম্পানিটি। ২০২২ সালে দিয়েছে ১২% ক্যাশ, ২০২১ সালে ১০% ও ২০২০ সালে ৫%। বুধবার কোম্পানিটির শেয়ার ২.৯৫ শতাংশ (পার্সেন্ট) উর্ধ্বমুখি দেখা গেছে।
অথচ মৌলভিত্তির কোম্পানি রেকিট বেনকিজার- যারা ২০২১ সালে ক্যাশ ডিভিডেন্ট দিয়েছে ৯৮০%, আর আগের বছর দিয়েছে ১৬৫০%, সেই কোম্পানির শেয়ারের বুধবার দাম কমেছে ৬৫ শতাংশ। যারা গত তিন বছর ধরে গড়ে ১০০% থেকে ১২০০% বা এর বেশি ডিভিডেন্ট ক্যাশ দিয়ে এসেছে, সেসব শেয়ারের দর বাড়ছেই না। কোনটি কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছে, কোনটির দাম পড়ছেই।
আলিফ ও লিগ্যাসির মতো এমন আরও দুটি দুর্বল কোম্পানি রূপালী লাইফ ও মেঘনা লাইফ। এ দুটির কারসাজির বিষয়ে গত ৫ জুন ‘রূপালী লাইফের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ, এখন কিনবেন তো ঠকবেন, সত্যি!’ এবং ‘রূপালী লাইফের কারসাজি চক্র মেঘনা লাইফেও?’ শিরোনামে আলাদা দুটি রিপোর্ট প্রকাশ হয়।
এর আগে ২০১৭ সালের মে থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত লিগ্যাসি ফুটওয়্যার কারসাজি করেছে বলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) তদন্তে প্রমাণিত হয়। এরপর ২০১৯ সালে লিগ্যাসি ফুটওয়্যার লিমিটেডসহ ১৫ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে সতর্ক করে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।
বিএসই ও ডিএসইসহ সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, এ কারসাজির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও কোম্পানির কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত। এ পর্যন্ত যেসব কারসাজির তদন্ত হয়েছে, সেসব তদন্তে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। গ্যাম্বলিংয়ে জড়িত কথিত বিনিয়োগকারীদের সিন্ডিকেটগুলোই দুর্বল কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি করে রাতারাতি দাম বৃদ্ধি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতানোর ফাঁদ পেতে থাকে।
বধবার শেয়ারবাজার ঘুরে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপকালে তারা কারসাজিচক্রের কাছে অসহায় বলে জানান। গ্যাম্বলাররাই তাদের ভয়।
জাহাঙ্গীর নামে একজন বিনিয়োগকারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, কয়েক লাখ টাকা শেয়ারবাজারে খুইয়েছেন- এখন পুঁজিবাজার ছাড়তেও পারছেন না, আবার শেষ সম্বলটুকুও যদি চলে যায় এই ভয়ও আছে।
‘শেয়ারবাজারে বুঝে ইনভেস্ট (বিনিয়োগ) করতে পারলে লাভ হয়। কিন্তু এটা বোঝার আগেই তো আমার মতো বিনিয়োগকারীরা সব হারিয়ে ফেলে। কর্তৃপক্ষ শক্তভাবে গ্যাম্বলারদের নির্মূল করলে আমাদের ভয় থাকবে না।’
বিনিয়োগকারী ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘পুঁজিবাজারটা চাঙ্গা আছে, ভালো লাগছে। নাবধানে বিনিয়োগ করছি। যেন গ্যাম্বলারের হাতে না পড়ে যাই।’
ঢাকা স্টকএক্সচেঞ্চ (ডিএসই) কর্তৃপক্ষ বলছে, কারসাজির বিষয়ে তাদের কড়া নজর রয়েছে। এ কারণে শেয়ারবাজার আগের তুলনায় সম্ভাবনাময় হয়ে উঠছে। প্রতিষ্ঠানটির উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান বলেন, ‘বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের দর বৃদ্ধির বিষয়ে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ডিএসইতে কারসাজির ব গ্যাম্বলারদের কোনো স্থান নেই, সধারণ বিনিয়োগকারীরা যাতে সুরক্ষিত থাকে তা নিশ্চিতে ডিএসই প্রধানসহ কর্তৃপক্ষ আন্তরিক।’
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) একজন কমিশনার বলেন, ‘মৌলভিত্তি সম্পন্ন শেয়ার বোঝাতে নানামুখী উদ্যোগ কমিশন গ্রহণ করেছে। আর পুরনো গ্যাম্বলারদের দিকে নজর রয়েছে। যাতে কোনো পক্ষ যোগসাজশ করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের লোভের ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করতে না পারে- সে বিষয়ে কমিশন সজাগ রয়েছে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, কমিশনের চেয়ারম্যান মহোদয়ের নির্দেশে আমাদের উইংগুলো অস্বাভাবিক দর বৃদ্ধি পাওয়া শেয়ারগুলোর বিষয়ে নিয়মিত পর্যালোচনা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যেই তিনটি কোম্পানির বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কমিশনের নিজস্ব মনিটরিং এবং গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সূত্রে যেসব কোম্পানির বিষয় উঠে আসে বা আমাদের দৃষ্টিতে আসে, আমরা তাৎক্ষণিক সে বিষয়ে কাজ শুরু করি। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ উপযোগী শেয়ারবাজার গঠনের লক্ষ্যে কমিশন কাজ করে যাচ্ছে। সূত্র: ঢাকা টাইমস