আজ ২৬ মার্চ (মঙ্গলবার)। ৫৪তম মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন।
‘৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাঙালির ওপর অতর্কিত গণহত্যা অভিযান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু করে। এদিনই তারা বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বঙ্গবন্ধুর ঐ ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। এরপরই হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াই শুরু করে এদেশের মুক্তিকামী জনতা। দেশ ও জাতির কাছে এ স্বাধীনতার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি ইসলাম ধর্মেও স্বাধীনতার রয়েছে অনন্য সম্মান ও স্বীকৃতি।
ইসলাম স্বাধীনতাকে অসামান্য সম্মানের দৃষ্টিতে গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। কারণ, ইসলাম পরাধীনতাকে পছন্দ করে না। আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মানুষকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করেছেন। প্রতিটি মানুষ তাই মাতৃগর্ভ থেকে স্বাধীন অবস্থায় জন্মগ্রহণ করে থাকে। আল্লাহ তাআলা কাউকে পরাধীন করেননি, পরাধীন করে সৃষ্টিও করেননি। তিনি সব মানুষকে তাদের বিবেক ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা প্রদান করেছেন।
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে ঘোষণা করেছেন, ‘তোমার প্রতিপালক চাইলে দুনিয়ার সব মানুষ একত্রে ঈমান গ্রহণ করতো। তুমি কি তাদেরকে মুমিন বানাতে বল প্রয়োগ করবে?’ (সূরা: ইউনুস, আয়াত: ৯৯)
উক্ত আয়াত দ্বারা স্পষ্টই বোঝা যায়, আল্লাহ তাআলা চাইলে সবাইকে মুমিন ও মুসলিম বানাতে পারেন। কিন্তু তিনি তা করেন না। কারণ এখানে মানবজাতিকে তিনি ঈমানদার হওয়ার স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। তিনি চেয়েছেন মানবজাতি বুঝে-শুনে ঈমান গ্রহণ করুক। জন্মগতভাবে মানুষের মনোজগৎ স্বাধীন সত্তার অধিকারী। বস্তুজগতেও তাই সে স্বাধীনতা পছন্দ করে।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ শুধুমাত্র আল্লাহর খলিফা। সে শুধু একমাত্র আল্লাহর কাছেই পরাধীন থাকবে। একান্তভাবে সে শুধু তাঁরই দাসত্ব করবে। সে অন্যায়ের কাছে নতি স্বীকার করবে না। ইসলামের দৃষ্টিতে এটাই মূলত মানুষের স্বাধীনতা। মহানবী (সা.) বিশ্ব মানবতাকে মানবীয় প্রভুত্ব এবং দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন। তৎকালীন আরব থেকে তিনি দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকা আরব জাতিকে মুক্ত করেছিলেন। দাসত্ব মুক্ত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, বরং তিনি দাসকে সন্তানের মর্যাদায় ভূষিত করেছেন; ভাইয়ের সমমর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন। দাসদের তিনি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করেছেন। তাদের পরিপূর্ণ অধিকার দিয়েছেন। আধুনিক যুগে দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলাকে বর্ণবাদবিরোধী জাতীয় নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ, তিনি সাদা-কালোর ব্যবধান দূর করতে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বর্ণবাদের অবসান করতে দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে তিনি প্রায় ৩০ বছর জেল খেটেছেন। অথচ, ইসলাম আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে এ বর্ণবাদী প্রথাকে বিলোপ সাধন করেছে। নবীজি (সা.) হাবশি বিলালকে (রা.) দাসত্ব থেকে মুক্ত করে মসজিদে নববীর মুআজ্জিন নিযুক্ত করেছিলেন। বর্ণবাদী প্রথা অবসানের এমন উদাহরণ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না।
আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার প্রথম স্তর হচ্ছে তাকে অন্তরে ধারণ ও লালন করা। দ্বিতীয়ত মুখের স্বীকারোক্তির মাধ্যমে অন্তরে লালিত ইচ্ছা মানুষের সম্মুখে প্রকাশ করা; আর সেটা প্রকাশের মূলমন্ত্র হলো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। ইসলামের এই কালিমাটি পরিপূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন একটি বাক্য। যেটা উচ্চারণের মাধ্যমে একজন মানুষ পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে থাকে। এ বাক্যের অর্থ হলো, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নাই, আর মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ’। প্রথমত এ বাক্য ঘোষণার মাধ্যমে মানুষ সব মানুষের অধীনতা ও পরাধীনতা হতে মুক্ত হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত সে মহানবী (সা.)-কে যুগসন্ধিক্ষণের একমাত্র আদর্শ নেতা হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। উল্লেখিত ঘোষণার মাধ্যমে একজন মুসলিম মানবসৃষ্ট যাবতীয় আদর্শ ও পরাধীনতার শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে পড়ে।
ইসলামী নীতির সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো, পার্থিব জীবনে ভালো কিংবা মন্দ-উভয়ই করতে মানুষ সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন। ইসলাম মানুষকে এই স্বাধীনতা সৃষ্টির শুরু থেকেই দিয়ে এসেছে। প্রাপ্ত এ স্বাধীনতা ও কর্মকাণ্ডের আলোকে মানুষ পরকালীন জীবনে আল্লাহর আদালতে বিচারের মুখোমুখি হবে। তার এ স্বাধীন কর্ম অনুযায়ী একটি ফলাফল নির্ধারিত হবে। এ ফলাফল অনুযায়ী সে জান্নাত কিংবা জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলা মানুষকে পার্থিব দুনিয়ায় চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা দিয়েছেন। তার ধর্ম-কর্ম পালনের ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়নি। ধর্ম পালনের ব্যাপারে মানুষকে জবরদস্তিও করা হয়নি।
আল্লাহ তাআলা আল কোরআনে বলেন, ‘ইসলামে কোনো প্রকার জবরদস্তি নেই। সত্য এবং মিথ্যা স্পষ্টভাবেই পার্থক্য হয়ে গেছে। ভুল এবং ভ্রান্ত পথ থেকে সঠিক পথ ও মতকে স্পষ্ঠভাবে আলাদা করে দেয়া হয়েছে। সুতরাং এখন যেকোনো ব্যক্তি মিথ্যাকে অস্বীকার করলো এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনলো; সে এমন একটি মজবুত অবলম্বন আঁকড়ে ধরলো, যা কখনো ছিন্ন হবার নয়’। (সূরা: আল বাকারা, আয়াত: ২৫৬)