রাজধানীর রাস্তায় নানা রকমের দৃশ্য দেখা গেলেও মধ্যরাতে ভ্যানে করে কেউ মাছ বিক্রি করছেন এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। তবে সময় সংবাদের চোখে এমনই দৃশ্য ধরা পড়ে মিরপুর-১ আনসার ক্যাম্পে।
রাত প্রায় ১২টা। সুনশান নীরব সড়কে মাছ বিক্রেতা মাসুক মিয়া হেঁকে চলেছেন, ‘ভাই মাছ লাগবে, মাছ। কমে ছাইড়্যা দিমু।’
আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলে মাসুক বলেন, ‘ভাই সারাদিন মাছ বেইচ্যাও অর্ধেকের বেশি মাছ রইয়া গেছে। আমি গরীব মানুষ, বাসায় তো আর ফ্রিজ নাই যে ওইখানে রাইখ্যা পরদিন আবার বেচুম। বরফ দিয়া রাখলেও মাঝে মধ্যে মাছ পইচ্যা যায়। আজকের মধ্যে মাছ বেচতে না পারলে পইচ্যা যাইবো সব। তখন পুরাডাই লস।’
প্রায়ই রাতে মাছ বিক্রি করেন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আন্ধার থাকতে (শেষরাতে) পিকাপে কইরা কিশোরগঞ্জ যাই। ওইখানের নিকলি হাওরের মাছ পাইকারি দামে কিন্না আনি। ঢাকা আইসা ভ্যানে এলাকায় এলাকায় মাছ বেচা শুরু করি। আগে একেকজন ২-৩ কেজি মাছ কিনতো। এখন মাইনষের হাতেও টাকা নাই। আধা কেজি এক কেজি কইরা মাছ কিনে। দিন শ্যাষে দেখা যায়, মাছ রইয়্যা যায়। মাছ থাকলে তো বিশাল লোকসান। সব ফালায়ে দেয়া লাগবো। তখন রাইত উজাগার (জেগে থেকে) হইয়া মাছ বেচি। বাকি যা থাকে বাসায় নিয়া বউরে কই রাইন্ধ্যা দিতে।’
নিকলি থেকেই কেন মাছ আনেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই হাওরের মাছে যেই স্বাদ এডি অন্য মাছে নাই। খাওয়াইলে মানুষরে দেশি ভালো মাছ খাওয়ামু। তাই কষ্ট হইলেও চাষের মাছ না আইনা ডিরেক্ট হাওর থেইক্কা নিয়া আসি।’
নিজের পরিবারের কথা বলতে গিয়ে মাসুক বলেন, ‘ভাই ঘরে বউ আর দুই পোলা আছে। একটা এক্কেবারে ছোট, ৬ বছর বয়স। আরেকটা ১১ বছরের। ওইটারে মাদরাসায় দিছি। অনেক কষ্টের মধ্যেও যখন বাসায় যাইয়্যা দেখি বউ ভাত বাইর্যা বইসা আছে আমার জন্য- মনে হয় বাইচ্যা থাকাটা যেমনি কষ্টের, তেমনি ছোট ছোট আনন্দও আছে।’
জীবনযুদ্ধে কীভাবে টিকে আছেন জানিয়ে মাসুক বলেন, ‘রাইতে মাছ বেচি দেইখ্যা ভালো কইরা ঘুমাইতে পারি না। ঘুমাই মনে করেন নিকলি থেইক্যা ফেরার পথে পিকাপে শুইয়া শুইয়া। মাঝে মধ্যে লস হয়, আবার মাঝে মধ্যে দুই-এক টাকা লাভও হয়। টান পড়লে এইখান থেইক্কা, ওইখান থেইক্কা লোন করি। ওইডা আবার ফেরত দেয়া ঝামেলা। ভাই, ঝামেলা থাকবোই। টিক্কা থাকাটা আসল কথা।’
মাসুকের কথার সঙ্গে বিখ্যাত আমেরিকান কথা সাহিত্যিক কার্ট ভোনেগাটের একটা বক্তৃতার দারুণ মিল রয়েছে। একবার আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে কার্ট ভোনেগাট শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘জীবন তোমাকে উপভোগ করার মতো কিছু হাতে তুলে দেবে না। তোমাকে শিখতে হবে কীভাবে জীবন উপভোগ করতে হয়। শত কষ্টের মধ্যেও বেঁচে থাকার আনন্দটাকে উদযাপন করতে হবে।’
সুনশান শীতের রাতে সিংহভাগ মানুষ যখন আরামে নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছেন, তখন মাসুক মিয়ারা এই শহরে টিকে থাকতে আনসার ক্যাম্পের মতো শহরের নানা অলি-গলিতে হেঁকে চলছেন, ‘ভাই মাছ নেবেন, মাছ। শেষ বেলায় কম দামে ছাইড়্যা দিমু।’