কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে দেশের ঐতিহ্যবাহী গরুদৌড় প্রতিযোগিতা। তবে এখনো কোনো কোনো জেলায় ধরে রাখা হয়েছে পুরনো এই ঐতিহ্য। এর মধ্যে অন্যতম মানিকগঞ্জ। প্রতিবছরের মতো এবারো আয়োজন করা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী গরুদৌড় প্রতিযোগিতা।
মঙ্গলবার বিকেলে হযরত কানু শাহ্ প্রামাণিকের ওরশ মোবারক উপলক্ষ্যে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার পুটাইল ইউনিয়নের মান্তা মাঠে এই গরুদৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেইসঙ্গে বসেছে সাত দিনব্যাপী গ্রামীণ মেলা।
মেলায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দুপুর গড়াতেই বিলুপ্ত প্রায় এ গরুদৌড় প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় উৎসবের আমেজ। আর রোমাঞ্চকর এ প্রতিযোগিতা ঘিরে আনন্দ মেলা ছিল বাড়তি আকর্ষণ। দুপুর ১২টার পর থেকেই মানিকগঞ্জ জেলাসহ আশপাশের এলাকা থেকে নানা আকার ও রঙের গরু নিয়ে আসতে শুরু করেন প্রতিযোগীরা। সব গরু মাঠে আসলে বিকেল ৪টার দিকে শুরু হয় শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী এই দৌড় প্রতিযোগিতা।
গরুদৌড় ও মেলা উপভোগ করতে দুপুর থেকেই জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার নারী, পুরুষ ও কিশোররা ভিড় জমায় মাঠের চারপাশেই। মেলায় মিলেছে খাবার, খেলনা, কসমেটিকস ও মাটির তৈজসপত্রের সমাহার। সবমিলিয়ে আয়োজনটি গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মান্তা এলাকার আমেনা খাতুন বলেন, ‘প্রতিবছর এই সময়ে হযরত কানু শাহ্ প্রামাণিকের ওরশ হয়। সেই উপলক্ষ্যে গরুদৌড় ও সাত দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়। আমি ছেলে-মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে এসেছি বেড়াতে। এ সময় আমাদের গ্রামের সবাই তাদের বাড়িতে পিঠা, পায়েস ও ভালো খাবারের আয়োজন করে থাকে। আমাদের এই সময়টা ঈদের মত মনে হয়। সবাই একত্রিত হই কয়েকদিনের জন্য।’
৭০ বছর বয়সী মোহাম্মদ আব্দুর রহমান মাঠের পশ্চিম প্রান্তে এক নিরাপদ স্থানে বসে গরুদৌড় দেখছিলেন। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক বছরই এইহানে গরুদৌড় হয়। আগে আব্বা দাদার সাতে আইতাম। তহন বড় বড় শিং আলা ম্যাল্যা গরু আইতো। এহনতো এতো গরু আহেনা। তারপরও যে কয়ডা আহে তার দৌড় দেখবার নিইগ্যা বহুত মানুষ আইছে। আনন্দ নাগে যহন গরু দড়ি ছিরা সবাইরে নিয়ে দৌড় দেয়।’
গরুদৌড় প্রতিযোগিতা দেখতে আসা মনির খান বলেন, ‘এখানে প্রতিবছর গরু দৌড় খেলা হয় এটা জানতে পেরে আজ শিবালয় উপজেলার তেওতা গ্রাম থেকে ৫ বন্ধু এসেছি। প্রচুর মানুষ এসেছে এখানে। মাঠের চারপাশের তিল পরিমান জায়গা নেই। আধুনিক যুগে এসে গরুদৌড় প্রতিযোগিতা দেখে খুব ভালো লেগেছে। এরকম প্রতিযোগিতা প্রায়ই আয়োজন করা প্রয়োজন।’
পুটাইল ইউপি চেয়ারম্যান মহিদুর রহমান ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই গরুদৌড় আমাদের এলাকার শত বছরের ঐতিহ্য। হযরত কানু শাহ্ প্রামাণিকের ওরশ মোবারক উপলক্ষ্যে আমরা সাত দিনব্যাপী গ্রামীণ মেলার আয়োজন করে থাকি। সেইসঙ্গে এই দিন বিকেলে বাড়তি আকর্ষণ থাকে গরুদৌড় প্রতিযোগিতা। এই আয়োজন ঘিরে এলাকায় ঈদের আমেজের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি বাড়িতেই পিঠা, পায়েস ও ভালো খাবারের আয়োজন করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘আধুনিকতার নামে আমরা আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোকে হারিয়ে ফেলতে বসেছি। গ্রামের মানুষের বিনোদনের জন্য এখন আর তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে আমাদের এমন গ্রামীণ আয়োজন অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট আয়োজক সংগঠনের সদস্যসহ গ্রামবাসী।