মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:১৮ অপরাহ্ন
নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ::
সিটিজেন নিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমের জন্য প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে। যারা আগ্রহী আমাদের ই-মেইলে সিভি পাঠান

করোনাকালে খবরের শিরোনামে তিন এমপি

  • আপডেট টাইম : বৃহস্পতিবার, ১১ জুন, ২০২০
  • ১৯৬ বার পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদক: করোনাকালে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আলোচনায় এসেছেন তিনজন জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি)। হয়েছেন বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন গণমাধ্যমের সংবাদের শিরোনাম। তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তারা নিজেরাই শুধু বিতর্কিত হননি ক্ষুন্ন করেছেন নিজ দল আওয়ামী লীগের সম্মানও। এমন তিনজন এমপিকে নিয়ে আজকের প্রতিবেদন;

স্বামী-স্ত্রী এমপির কাহিনি: রাজনীতিতে পোড়খাওয়া প্রবীণ নেতারা এমপি হতে না পারলেও হঠাৎ বিদেশ থেকে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসেই’ হয়ে গেছেন বাংলাদেশের আইন প্রণেতা বা জাতীয় সংসদ সদস্য। শুধু কী তাই? এই ‘এমপি’র স্ত্রীর শখ পূরণে তাকেও সংসদে এনেছেন একই পথে। ‘দলবিহীন’ স্বামী-স্ত্রী এমপি হতে অবশ্য ‘কোটি-কোটি’ টাকা লগ্নি করতে হয়েছে বলে শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল।
এ হলো লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল ও সেলিনা ইসলাম দম্পত্তির ঘটনা। কুয়েতে অর্থ ও মানব পাচার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে পুলিশের হাতে আটক ও রিমান্ডে থাকা বাংলাদেশের আইন প্রণেতা পাপুল এখন বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচনায় এসেছেন। অর্থ ও মানব পাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব যখন এক অভিন্ন সুরে কথা বলছে, তখন অভিযুক্ত বাংলাদেশের একজন আইন প্রণেতার কারণে দেশের মাথা নত হয়ে আসছে। এমপি হওয়ায় তিন বছর আগেও যাকে কখনো এলাকায় দেখা যায়নি, একদিনও রাজপথে মিছিল মিটিং করতে হয়নি-সেই ব্যক্তি ও স্ত্রীর এমপি হওয়া যেন রূপকথার গল্পের মতোই। লক্ষ্মীপুরের স্থানীয় রাজনীতিবিদ, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে এমনই সব তথ্যই পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, জন্মের পর পাপুলের বেড়ে ওঠা ঢাকা ও চট্টগ্রামে। ১৯৯২ সালে তার ভাই বিএনপি নেতা কাজী মঞ্জুরুল আলমের হাত ধরেই মরুভূমির দেশ কুয়েতে পাড়ি জমান তিনি। মরুর বুকে গড়ে তোলেন টাকার পাহাড়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দেড়-দুই বছর আগে ২০১৬ সালে লক্ষ্মীপুরে আবির্ভূত হন কাজী পাপুল। স্থানীয় একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন এলাকায় জনসেবা করতে এসেছেন তিনি। নিজে মুখেই বলেন, ‘জন্মের পর প্রথম এসেছি। রায়পুরকে জেলায় রূপান্তরিত করতে চাই।’ এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জামশেদ কবিরের হাত ধরে দান-খয়রাত শুরু করেন। স্থানীয় কিছু নেতা ও যুবকদের মোটরসাইকেল কিনে দিয়ে নিজের দলভারী করেন। কথায় কথায় টাকা পয়সা ঢেলে এলাকায় অল্প দিনে মানবতার সেবক বনে যান।
২০১৮ সালে তিনি লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেতে বিশাল শোডাউন করে ধানমন্ডি দলীয় সভানেত্রীর কার্যালয় থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। আর তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সিআইপি নৌকা পেতে কুমিল্লা-১ (মেঘনা-দাউদকান্দি) মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। কিন্তু চূড়ান্ত তালিকায় দুজনই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হন। লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি আওয়ামী লীগ মহাজোট প্রার্থীকে ছেড়ে দেয়। মহাজোটের প্রার্থী করা হয় জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মোহাম্মদ নোমানকে। আর কুমিল্লা-২ আসনে নৌকার টিকিট পান প্রবীণ রাজনীতিবিদ সুবিদ আলী ভুঁইয়া। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হলেও ‘এমপি’ হওয়ার দৌড়ে থেমে থাকেননি পাপুল। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন তিনি।

আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী মহাজোটের প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালায়। পাপুলের শখের ‘এমপি’ হতে বাধা হয়ে দাঁড়ান জাতীয় পার্টির নোমান। তার সঙ্গে সমাঝোতার চেষ্টা করেন পাপুল। অবশেষে সফল হন। ১৯ ডিসেম্বর হঠাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘বিজ্ঞপ্তি’ দিয়ে ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিজ্ঞপ্তিতে তিনি নিজ দল জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, লক্ষ্য নির্ধারণে অনিশ্চয়তা, কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয় ও সিদ্ধান্তহীনতা এবং মহাজোটের স্বতন্ত্র প্রার্থী পাপুলের (আপেল প্রতীক) নির্বাচনে বহাল থাকার কথা উল্লেখ করেন নোমান। ওই সময়ে ২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর একটি চিঠি প্রেরণ করা হয়। চিঠিতে লেখা হয়, ‘আপনারা সদয় অবগত আছেন যে, লক্ষ্মীপুর-২ সংসদীয় আসন ২৭৫ এর মহাজোট মনোনীত প্রার্থী মো. নোমান মহাজোটের বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শহীদ ইসলামের সমর্থনে তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন। আপনাদের জানা আছে যে, মো. শহীদ ইসলাম আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত নেতা ও সক্রিয় কর্মী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বৃহত্তর স্বার্থে এই আসনের বিজয় দলের পক্ষে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই লক্ষে মো. শহীদ ইসলামকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে নির্বাচন কমিশনকৃত তার প্রতীকে বিজয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ অতীব জরুরি। এই মর্মে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের শহীদ ইসলামকে সমর্থন প্রদানের জন্য আপনারা নিদের্শ দিতে পারেন। এই বিষয়ে আপনাদের সর্বত্মক সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।’ দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যানের পক্ষে চিঠি স্বাক্ষর করেন সমন্বয়ক ড. সেলিম মাহমুদ। সেলিম মাহমুদ বর্তমানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

এরপর ২২ ডিসেম্বর শহরের তাজমহল সিনেমা হলের সামনে দলের জরুরি সভায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু প্রকাশ্যে বলেন, ‘বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নোমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।…অনেক টাকা, অনেক টাকা।’ তার এই বক্তব্য নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সভায় নেতাদের মধ্যে বিতন্ডা ও হাতাহাতিও হয়।

তখনকার জাপা দলীয় এমপি নোমানের ব্যক্তিগত সহকারী শাহ আলম নিজেও তখন গণমাধ্যমের কাছে বলেছিলেন, ‘পাপুলের কাছ থেকে ১২ কোটি টাকা নিয়ে তিনি (নোমান) সরে দাঁড়িয়েছেন বলে আমরা শুনেছি। তবে ওনাকে (নোমানকে) কয়েক দিন ধরে ফোনেও আমরা পাচ্ছি না।’ আর পাপুল তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘গত আড়াই বছরে আমি এলাকায় বিপুল কাজ করেছি। প্রায় ৩২ কোটি টাকা মানবসেবায় খরচ করেছি।’ নোমানের সঙ্গে টাকার লেনদেনের বিষয়ে পাপুল তখন বলেছিলেন, ‘উনি ফাইন্যান্সিয়ালি (আর্থিকভাবে) দুর্বল। নির্বাচনে থাকলে বড়জোর ৫ হাজার ভোট পেতেন। এসব বুঝেই উনি সরে দাঁড়ান। এখানে লেনদেনের ঘটনা ঘটেনি।’

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, দলীয় এমপি প্রার্থী ঠিক করা বা মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাক্ষর করে থাকেন। কিন্তু আদম ব্যবসায়ী পাপুলের ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে। সূত্রটির দাবি, এজন্য নানা রকম কল্পকাহিনী দলের ভিতরে-বাইরে আলোচনা আছে। এক-দুজন প্রভাবশালী নেতা পাপুলকে আওয়ামী লীগের ফ্লেভার দিয়ে ‘দলহীন’ ব্যক্তিকে এমপি বানিয়েছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পাঠানোর চিঠি পেয়ে আওয়ামী লীগের সব শ্রেণির নেতাকর্মী ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাপুলের বিজয় নিশ্চিত করেন। এ হলো পাপুলের এমপি হওয়ার গল্প।

নিজের স্বপ্ন পূরণ হলেও নৌকার মনোনয়ন বঞ্চিত স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে সংসদে আনার মিশনে নামেন হঠাৎ এমপি হওয়া পাপুল। প্রথমে স্বতন্ত্র কোটায় এমপি করার মিশনে নামেন তিনি। বর্তমান সংসদে তিনজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য থাকায় কিছুটা হোঁচট খান। কারণ সংরক্ষিত নারী আসনে এমপি হতে হলে ছয়জন এমপির ভোট প্রয়োজন হয়। সে সময়ে আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার পরামর্শে এমপিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন পাপুল। এবারও তার সাফল্য হাতে ধরা দেয়। বউকে এমপি বানাতে তার স্বপ্ন পূরণ হয়। এতে অবশ্য কোটি কোটি টাকার খরচ করতে হয়েছে বলেও পাপুলের ঘনিষ্ঠ একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারিতে অবৈধ ভিসা ব্যবসার দায়ে পাপুলের বিরুদ্ধে কুয়েত সিআইডি রিপোর্ট করলে গা ঢাকা দিতে দেশে ফিরে আসেন তিনি। বিভিন্ন গণমাধ্যমে তখন খবর আসে ‘কুয়েত থেকে লাপাত্তা পাপুল।’ এবার তিনি করোনার মধ্যেই কুয়েত ফিরে নিজেকে জাহির করতে ৯ মার্চ ফেসবুক লাইভে আসেন এবং সেখানে দম্ভ নিয়ে বলেন, ‘আমি কাচের পাহাড় তৈরি করিনি, আমি পাথরের পাহাড় তৈরি করেছি… এটা ভাঙবে না, কেউ ভাঙতে পারবে না।’ গত শনিবার রাতে তিনি কুয়েত সিআইডি পুলিশের হাতে আটক হয়ে রিমান্ডে রয়েছেন। বিষয়টি শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্ব মিডিয়ায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের একজন আইন প্রণেতার অর্থ ও মানব পাচারের ঘৃণ্য অপরাধটির।

গত শনিবার রাতে কুয়েতের মুশরিফ আবাসিক এলাকার বাসা থেকে পাপুলকে গ্রেফতার করে কুয়েত সিআইডি। রবিবার তাকে আদালতে হাজির করে জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানো হয়। সোমবার তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেয় কুয়েতের আদালত। কুয়েতে মুদ্রা ও মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে কুয়েতি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন তারই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রবাসী ৫ বাংলাদেশি। সাক্ষীদের সবাইকে কুয়েতে নিয়েছিলেন পাপুল। কুয়েতি আদালতকে তারা বলেন, ‘কুয়েত আসার জন্য তারা পাপুলকে তিন হাজার কুয়েতি দিনার করে দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রতি বছর আকামা নবায়নের জন্য দিয়েছেন ৩০০ দিনার বা তারও বেশি।’

আবারও খবরের শিরোনাম নাঈমুর রহমান দুর্জয়: এদিকে, আবারও খবরের শিরোনাম হয়েছেন নাঈমুর রহমান দুর্জয়। মানিকগঞ্জের শিবালয়, ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত মানিকগঞ্জ-১ সংসদীয় এলাকা। দেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক নাঈমুর রহমান দুর্জয় এ আসনের সংসদ সদস্য। বিগত নির্বাচনের মনোনয়ন দৌড়ে এলাকার প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের পেছনে ফেলে নৌকা প্রতীক পান এই ক্রিকেটার। বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের পর এলাকার গরিব মানুষের কাছ থেকে চাকরি দেয়ার নামে টাকা আদায়সহ নানা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। ফলে খ্যাতিমান এ ক্রিকেটারের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা। তাদের মতে, তিন উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। টিআর, কাবিখা প্রকল্পের গম, চাল আত্মসাৎ, সোলার প্যানেলের বরাদ্দ নিয়ে হরিলুট হয়েছে। সরকারি এসব বরাদ্দ আত্মসাৎ করতে ভুয়া প্রকল্প দাখিল করা হয়। বাস্তবে কয়েকটি প্রকল্পে সরেজমিন দেখা গেছে, কোনো কাজই হয়নি। প্রকল্প চেয়ারম্যানদের কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বাকি সব পকেটে পুরেছেন এমপির ঘনিষ্ঠরা। এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে অভিযোগও করা হয়েছে।

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয় বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। চাকরিপ্রার্থীরা যাকে ঘুষ দিয়েছেন তাদেরকে জিজ্ঞাসা করুন।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে আলাদা কর্মকর্তা আছেন। তাদের দায়িত্বটা কি? এমপি হিসেবে আমার কাছে যেসব প্রকল্প আসে সেগুলোতে গুরুত্ব ভেবে বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে কাজ হচ্ছে, না লুটপাট হচ্ছে এসব দেখার দায়িত্ব প্রকল্প কর্মকর্তাদের।’ তিনি বলেন, যেসব বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সেগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের নির্বাচনী এলাকার অসংখ্য বেকার যুবক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরির আশায় সর্বস্ব খুইয়েছেন। তারা এমপি দুর্জয়ের পেছনে যেমন মাসের পর মাস ধর্ণা দিয়েছেন, চাকর বাকরের মতো ফুট ফরমায়েশ খেটেছেন তারপরও চাকরি নিশ্চিত করতে এমপি‘র ঘনিষ্ঠদের হাতে তুলে দিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। কিন্তু শেষমেষ তাদের কারোরই ভাগ্যে চাকরি জোটেনি, ফেরত পাননি টাকাগুলোও। ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষজন চড়া সুদে আনা টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে প্রতি মাসে সুদ গুনতে বাধ্য হচ্ছেন। এমপির বাসভবনে চাকরির প্রলোভন দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রতারণামূলক কান্ড থেকে দলীয় নেতা কর্মিরা পর্যন্ত রেহাই পাননি। মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের চরকাটারী ইউনিয়ন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক। দলীয় পদবি ব্যবহার করে কোথাও প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেননি। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজির সঙ্গেও জড়িত নন তিনি। অভাবী পরিবারের সন্তান আবু বকর সিদ্দিক স্বপ্ন দেখেন ছোট একটি চাকরির। কিন্তু চাকরি তো হয়ই-নি, উল্টো স্থানীয় সংসদ সদস্য দুর্জয়ের নামে তারই ভাগ্নে আব্বাস ঘুষ বাবদ হাতিয়ে নিয়েছেন ৫ লাখ টাকা। টাকা নিলেও তার চাকরি জোটেনি। টাকাও ফেরত দেয়া হয়নি। সেই টাকার বিপরীতে গত প্রায় আড়াই বছর ধরে সুদের ঘানি টানছে তার পরিবার। তিনি বলেন, ‘টাকা ফেরত না পেয়ে আমি এমপি সাহেবের (দুর্জয়) সঙ্গে গত মঙ্গলবার (২৩ নভেম্বর) ঢাকায় তার লালমাটিয়ার বাসায় দেখা করি। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, আরও কিছুদিন ধৈর্য ধর। আবার সার্কুলার দিলে তোর চাকরি হয়ে যাবে।’

একই উপজেলার লাউতারা গ্রামের মৃত মহির উদ্দিনের এতিম ছেলে আবদুল আজিজও এমপি চক্রের নির্মম চাকরি বাণিজ্যের শিকার হয়েছেন। স্কুলে পিয়নের চাকরি নিতে তাকেও খোয়াতে হয়েছে ১৪ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তোলা একটি গাছের বাগান এবং এনজিও থেকে নেয়া ঋণের পুরোটাই। এ প্রসঙ্গে আজিজ বলেন, ‘পিয়ন পদের জন্য ঘুষ বাবদ সব মিলিয়ে ৬ লাখ টাকা এমপির ঘনিষ্ঠ আব্বাসের কাছে পৌঁছে দেই। কিন্তু ভাগ্যে জোটেনি চাকরিটি, ফেরত পাননি টাকাও।’ উপরন্তু নানামুখি বিপদে পড়েছেন আব্দুল আজিজ। একদিকে এনজিও‘র কিস্তি বাবদ প্রতি সপ্তাহেই হাজার টাকা গুণতে হচ্ছে, অন্যদিকে ঋণ বাবদ পৌঁছাতে হচ্ছে চড়া সুদ। পরিবারের সদস্যদের মুখে দু‘বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দেয়াটাই যার জন্য কষ্টকর, তার মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এমপি চক্রের ঘুষের ধকল।

জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, শুধু দৌলতপুর উপজেলায়ই ১২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাইট গার্ড কাম পিয়ন পদে নিয়োগ বাণিজ্য হয়েছে। শুধু চাকরি নয়, টিআর, কাবিখা ও সোলার প্যানেল বরাদ্দে অনিয়ম-দুর্নীতির শেষ নেই। এলাকায় আছেন এমপির তিন ‘খলিফা’। যারা প্রতিটি বরাদ্দ থেকে পারসেন্টেজ আদায় করেন। দৌলতপুর উপজেলার চকমিরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, সংসদ সদস্য নাঈমুর রহমান দুর্জয়ের জনপ্রিয়তাকে গিলে খাচ্ছেন তার পরিবারের সদস্যরা। তারা টাকা ছাড়া কোনো কাজ করেন না। নিয়োগ বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে এমপি পরিবারের পকেটে। তিনি বলেন, এমপি দুর্জয়ের চাচা তায়েবুর রহমান টিপু, চাচাতো ভাই জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহবুবুর রহমান জনি ও ছাত্রলীগ নেতা আব্বাসসহ কয়েকজনের হাতেই বন্দি এই নির্বাচনী এলাকার উন্নয়ন। তাদের দাপুটে প্রভাব ও স্বেচ্ছাচারিতার কাছে পুরনো আওয়ামী লীগ নেতারা কোণঠাসা হয়ে আছেন।

নির্বাচনী এলাকার তিনটি উপজেলাতেই সরকারি সব প্রকল্প থেকে অগ্রিম ১০ পার্সেন্ট কমিশন আগাম বুঝিয়ে দেয়ার পরই এমপি‘র ডিও লেটার পাওয়া সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি দৌলতপুর উপজেলার চন্দ্রখোলা বিল খনন কাজের ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প কাজের জন্যও তিনি আগাম ৪ লাখ টাকা আদায় করে নেন। চকমিরপুর ইউনিয়ন পরিষদের ২০ লাখ টাকা বরাদ্দের পুরোটাই আত্মসাৎ করার অভিযোগও উঠেছে এমপি দুর্জয়ের বিরুদ্ধে। এছাড়াও সমেতপুর পূর্ব ও পশ্চিম রাস্তা সংস্করণে টিআর কাবিখা প্রকল্পের মোট ৮ লাখ টাকার কাজ না করেই আত্মসাৎ করেন উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুস ও এমপির পিএস আনোয়ার। বাঁচামারা নদীরক্ষায় জিও ব্যাগ বাবদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাদ্দের ১ কোটি টাকার পুরোটাই এমপির তত্বাবধানে আত্মসাৎ করার ঘটনা ঘটেছে। দৌলতপুর মতিলাল ডিগ্রি কলেজকে সরকারি করণ বাবদ ১০ লাখ টাকা, পিএস উচ্চ বিদ্যালয় সরকারিকরণ বাবদ ১৫ লাখ টাকা নেন এমপি। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতাধিক পদে লোক নিয়োগের নামে এমপি চক্রের বিরুদ্ধে খোলামেলা ঘুষ বাণিজ্য চালানোর গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এমপি এনামুলের: অন্যদিকে, বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এমপি এনামুলের। ব্যবসায়ী এনামুল হক ২০০৮ সালে রাজশাহী-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। সিনিয়র অনেক নেতাকে পাশ কাটিয়ে তার মনোনয়ন পাওয়া ছিল রীতিমতো চমক। তারপর এলাকায় নানা কারণে তিনি ছিলেন আলোচনায়। নিজে যেমন নিয়োগ বাণিজ্য, দ্বিতীয় বিয়ে, জঙ্গিদের নেতৃত্বে এনে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তেমনি দলের একটি অংশ সব সময় তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে আছে। ফলে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না এমপি এনামুলের।

স্বামী দাবি করে ফেসবুকে নারীর পোস্ট : এমপি এনামুল হককে স্বামী দাবি করে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দিয়েছেন এক নারী। লিজা আক্তার আয়েশা নামের ওই নারী নিজেকে এমপির স্ত্রী দাবি করছেন। ওই নারীর বাড়ি নগরীর তেরখাদিয়া এলাকায়। এনামুলের সঙ্গে যুগল একাধিক ছবিও তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেন। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় চলছে।

তবে এনামুল হক দাবি করেছেন, ওই নারীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। আইনগতভাবে ডিভোর্সও হয়েছে। নানা সময়ে টাকার জন্য ব্ল্যাকমেইল করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এভাবে তার সম্মানহানি করা হচ্ছে। সম্প্রতি ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তিনি।

গত ৩০ মে লিজা আক্তার আয়েশা প্রথম ফেসবুকে লিখেন, ‘এমপি সাহেবের রক্ষিতা বা প্রেমিকা নই, দ্বিতীয় বউ আমি।’ আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেন, ‘এমপি সাহেব আমার হাজব্যান্ড (স্বামী) এই কথাটা যদি কারও কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়, তারা বিয়ের কাগজ দেখতে পারেন।’ এর দুই ঘণ্টা পরে আরেক পোস্টে তিনি লিখেন, ‘একজন সংসদ সদস্য অনেক বড় অবস্থানের মানুষ। তার বিরুদ্ধে চাইলেই কেউ মিথ্যা অপবাদ দিতে পারে না। আমার কথাগুলো যদি মিথ্যা হতো তাহলে এতক্ষণে পুলিশ আমাকে থানায় নিয়ে যেত। আমি যা কিছু বলছি এবং বলব সব সত্যি। আপনারা আমাকে বিরক্ত না করে ধৈর্য ধরে পাশে থাকুন।’ এরপর এনামুলের সঙ্গে একাধিক ছবিও পোস্ট করেন লিজা।

লিজা আরেকটি পোস্টে লিখেন, ‘২০১৮ সালের ১১ মে আমাদের বিয়ে হয়। প্রথমে আট বছর আগে আমাদের বিয়ে হয় মৌখিকভাবে। তার বাগমারার বাড়িতে। কিন্তু লিখিত বিয়ের পর গত দুই বছর ধরে তিনি আমাকে গোপনে স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে আসছেন। এখন তিনি একটি ভুয়া কাগজ করে আমাকে তালাক দিয়েছেন। সেখানে আমার স্বাক্ষর জাল করা হয়েছে। এ কারণে আমি পরিস্থিতির শিকার হয়ে ফেসবুকে এসব কথা বলেছি। আমি সংসার করতে চাই আমার স্বামীর সঙ্গে।’ এই প্রতিবেদককে ফোন করে লিজা আক্তার আয়েশা এমপি এনামুলকে নিজের স্বামী দাবি করে বলেন, ‘আমি তার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাই।’ মামলা করছেন না কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আদালত খুললে মামলা করব।’

লিজার বিরুদ্ধে মামলা : এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অপপ্রচারে’র অভিযোগে লিজার বিরুদ্ধে এমপির পক্ষে মামলা করেছেন তার একান্ত সহকারী ও বাগমারা উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান আসাদ। বাগমারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতাউর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর এমপি এনামুল হকের পক্ষে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ও চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে মামলা করা হয়। এতে আসামি করা হয়েছে এনামুল হকের তালাক দেওয়া দ্বিতীয় স্ত্রী আয়েশা আক্তার লিজাকে। মামলায় বলা হয়েছে, আয়েশা আক্তার লিজাকে তালাক দেওয়ার পর তিনি এমপি এনামুল হকের কাছে নিজের ব্যাংক লোনের এক কোটি টাকা পরিশোধের জন্য চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা না দেওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছবি দিয়ে এনামুল হকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে তার সুনাম ক্ষুন্ন করেছেন।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনামুল হকের হলফনামায় বলা হয়, ২০০৮ সালে শুধু বেতন-ভাতা থেকে তার বছরে আয় ছিল ২০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পর এখন কৃষি, বাড়ি ও দোকান ভাড়া, ব্যবসা ও পেশা থেকে বছরে তার আয় হয় ৫০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর আগে তার পরিবারের পোষ্যদের ৭ লাখ ৫১ হাজার ৬০০ টাকা বার্ষিক আয় থাকলেও এবারের হলফনামায় পোষ্যদের কোনো আয়ের উৎস নেই বলে উল্লেখ করা হয়। তার নিজের, স্ত্রীর ও অন্যদের মোট ১৬ কোটি ১৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার সাধারণ শেয়ার থেকে কোনো আয় নেই উল্লেখ করা হয় হলফনামায়। পাঁচ বছর আগে তার স্ত্রীর নামে থাকা ২ কোটি ৮৯ লাখ ৬৩ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। নিজ নামে ব্যাংকে আছে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৯১ টাকা ও স্ত্রীর নামে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা।

এনামুল হক অবশ্য জানিয়েছেন, তার এই সম্পদের হিসাব ৬ বছর আগের। দুদক যা জানতে চেয়েছিল, তিনি তার জবাব দিয়েছেন। নিজের কোনো অবৈধ সম্পদ নেই বলে দাবি করেন এনামুল হক।

সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত খবর।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
© All rights reserved  2019 CitizenNews24
Theme Developed BY ThemesBazar.Com