ঢাকা শহরের যানজটের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র ‘গুপী গাইন বাঘা বাইনের’ সাদৃশ্য পাওয়া যায়। চলচ্চিত্রে গুপি যখন গান করত তখন আশপাশের সবকিছু ফ্রিজ হয়ে যেত। একই দশা যেন ঢাকার রাস্তাঘাট ও পাবলিক ট্রান্সপোর্টে। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কেন তীব্র যানজটে থমকে থাকে ঢাকা শহর? এর কারণগুলো আসলে কী?
অপরিকল্পিত নগরায়ন, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাত দখল, গাড়ি অনুযায়ী রাস্তার স্বল্পতা, রাজধানীকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা স্থাপন, ট্রাফিকদের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়ম, পরিকল্পিত পরিকল্পনার অভাব, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, আইন-আদালত, সচিবালয়, টার্মিনাল, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল অফিস ঢাকার মূল পয়েন্টগুলোতে স্থাপনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়হীনতা ও সদিচ্ছার অভাব তো আছেই।
‘ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯’-এ প্রকাশিত সূচকের তথ্যমতে, বিশ্বের সবচেয়ে যানজটপূর্ণ শহরের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ঢাকা। এ শহরে একটি গাড়ি ঘণ্টায় মাত্র ৫ কিলোমিটার যেতে পারে। বর্তমানে যানজটের কারণে কর্মঘণ্টার যে অপচয় হচ্ছে এর ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। অথচ সঠিক পদক্ষেপ নিলে এ যানজট নিরসন করা সম্ভব বলে মনে করেন অনেকে।
এ বিষয়ে ট্রাফিক-মিরপুর বিভাগের এডিসি মো. মিজানুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে যানজট লাগার অসংখ্য কারণ আছে। তার মধ্যে অন্যতম রাস্তার তুলনায় অতিরিক্ত গাড়ি নামা। নতুন করে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ গাড়ি ঢাকা শহরের রাস্তায় নামে। এইযে এতগুলো গাড়ি নামলো, এসব গাড়ির জন্য নতুন রাস্তা তো হচ্ছে না। গাড়ির কথা না হয় বাদই দিলাম, এইযে এতো এতো রিকশা চলছে- এগুলো কিন্তু কোনো সুনির্দিষ্টি নিয়মনীতি মেনে চলছে না। যার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
ফুটপাত দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ফুটপাত দিয়ে তো আর গাড়ি চলে না। তবে এটাও একটা কারণ। এছাড়া যে রাস্তায় ইঞ্জিনচালিত যানবহন চলছে, একই রাস্তায়ই ইঞ্জিনবিহীন যানবহনও চলছে। একটা প্রাইভেট গাড়ির সামনে যদি একটা রিকশা চলতে থাকে এতে গতির তারতম্য হয়। এ ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত কারণেও যানজটের পরিমাণ বাড়ছে। পাশাপাশি ঢাকার অবকাঠামোগত ব্যাপারগুলোর দিকেও যদি নজর দেই- মেট্রোরেলের কাজের কারণে কিন্তু উত্তরা ও মিরপুরের দিকে জ্যাম লেগেই থাকে।
যত্রতত্র পার্কিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশের সবজায়গায় সুনির্দিষ্ট পার্কিং সুবিধা নেই। এতে করে রাস্তাকেই অনেকে পার্কিং লট হিসেবে ব্যবহার করছে। এমনিতেই আমাদের রাস্তা অতটা প্রশস্ত নয়, সেখানে যদি আবার বিনা কারণে যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করে রাখা হয় তাহলে যানজট তো লাগবেই।
এসব সমস্যার সমাধান কী জানতে চাইলে ট্রাফিক-মিরপুর বিভাগের এডিসি মিজান বলেন, এটা আসলে একপক্ষীয় কোনো কাজ না। সমষ্টিগতভাবে প্রতিটি বিভাগকে এলাকাভিত্তিক কাজ করতে হবে। আবার শুধু সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোই যদি কাজ করে তাতেও হবে না। যারা শহরের বাসিন্দা তাদেরকেও সচেতন হতে হবে। আমরাই কিন্তু জেব্রা ক্রসিং কিংবা ওভারব্রিজ ব্যবহার না করে হেঁটে রাস্তা পার হই। এ ধরণের অসচেতনতামূলক কাজও কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি করে।
পরিকল্পিত নগরায়নের অভাবই যানজটের প্রধান কারণ। মহানগরের ক্ষুদ্রমেয়াদি পরিকল্পনাগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে দেখা হয় রাজউকের প্রভাবশালী কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। এদেরকে মদদ দেয় কিছু দলীয় প্রভাবশালী মন্ত্রী, এমপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি, এমন অভিযোগ করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকেরই এক কর্মকর্তা।
প্রতিদিন লাখ-লাখ কর্মজীবী, ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পেশার মানুষের সঙ্গে সারাদেশ থেকে অফিসের কাজে আগত মানুষের ভিড়ে চাপ সৃষ্টি হয়। এদের চলাচলের জন্য পরিবহন ও থাকার জন্য বাসস্থান দরকার। এ জন্য গাড়িও বৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো রাখার জায়গা নেই। ফলে যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া দেশের গার্মেন্টস শিল্প, মিল-কলকারখানাসহ সবকিছু ঢাকাকেন্দ্রিক গড়ে ওঠায় গ্রাম ও শহরের মানুষকে এখানেই তাদের কর্মসংস্থানের সন্ধান করতে হচ্ছে। এতো বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্যও সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
উন্নত দেশগুলোতে লোকসংখ্যা কম, আবার বড় বড় জনবহুল শহরে প্রশস্ত রাস্তাও রয়েছে এবং রয়েছে বিকল্প রাস্তা। মাটিতে, পানিতে বা উপরে। কিন্তু ঢাকার রাস্তা সংকীর্ণ। পৃথক লেনের জন্য রাস্তা বৃদ্ধির কোনো জায়গা নেই। উলটো রাস্তার ধারে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বড় বড় ইমারত ও ঘর-বাড়ি। কিছু কিছু জায়গায় মানুষের চলার পথের ফুটপাতে দেখা যায় মার্কেট এবং বস্তিবাসীদের দ্বারা দখল হয়ে আছে চলার পথ। অথচ রাস্তার ওপর অবস্থান করা এবং পসরা সাজিয়ে বসা একেবারে অনৈতিক। এদের অবস্থান যানজট সৃষ্টির জন্য প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে দায়ী।
রাজধানীতে যেভাবে গাড়ি বৃদ্ধি করা হচ্ছে সেভাবে রাস্তা বৃদ্ধি হচ্ছে না এবং যা আছে তার অধিকাংশ সংকীর্ণ। গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গাও নেই। ফলে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রাইভেটকার জাতীয় গাড়ির চেয়ে পাবলিক সার্ভিসের বড় গাড়িগুলো তুলনামূলক কম রেজিষ্ট্রেশন দেয়া হয়। এর সাথে যোগ হচ্ছে ফিটনেসবিহীন গাড়ির সংখ্যা। ঢাকাতে বর্তমানে এই সংখ্যা ৮০ হাজার ৬৮৫টি। এর মধ্যে ১৪ হাজার বাস-ট্রাক ২০-২৫ বছরের পুরনো। অধিক যানবাহনও যানজট সৃষ্টি করে।
ঢাকাসহ সারাদেশে বাস-ট্রাকের সংখ্যা ১৩ লাখ। এর জন্য লাইসেন্সধারী চালক রয়েছে ৯ লাখ। বাকি ৪ লাখের লাইসেন্স ভুয়া। টাকার মাধ্যমে দালাল ধরে তারা এসব ভুয়া লাইসেন্স জোগাড় করছে।
এদিকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা জোরদার হওয়ার পরিবর্তে দিন দিন তা আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ট্রাফিকদের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণেও যানজটের সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে ট্রাফিক রমনা বিভাগের এডিসি মো. সোহেল রানা বলেন, এটা তো অনেক লম্বা বিষয় (ট্রাফিক সিগন্যালের মতো)। এটা একদিনে বা এক কথায় সমাধান হওয়ার বিষয় না। শুধু আমাদের দোষ দিলে হবে না, সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।