নিজস্ব প্রতিবেদক,সিটিজেন নিউজ: পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নির্দিষ্ট মূল সড়কে চলাচল করছে না রিকশা। মূল সড়ক ছেড়ে ভেতরের গলিগুলোতে ভিড় জমিয়েছেন রিকশাচালকরা। রোববার সকালে কুড়িল, নতুন বাজার, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ রেলগেট, খিলগাঁও হয়ে সায়েদাবাদের সড়কে রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়নি। তবে ভেতরের গলিগুলো থেকে যাত্রী নিয়ে প্রধান সড়কে যাত্রী নামাতে দেখা গেছে চালকদের। সড়কগুলোতে অন্য দিনের তুলনায় কম যানজট দেখা গেছে।
মূল সড়কে রিকশা না থাকায় বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। প্রতিটি লোকাল বাসেও দেখা গেছে অতিরিক্ত ভিড়। রিকশা না পেয়ে গণপরিবহনের জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করতে হচ্ছে যাত্রীদের। বাসগুলোও যাত্রীতে ঠাসা। এমন অবস্থায় যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছেন, যাত্রী পরিবহনের নির্দিষ্ট ব্যবস্থা না করেই সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
গত ৩ জুলাই রাজধানীর নির্দিষ্ট মূল সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র সাঈদ খোকন। প্রাথমিকভাবে গাবতলী থেকে আসাদগেট হয়ে আজিমপুর ও সায়েন্স ল্যাব থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রিকশা চলাচল করবে না। এ ছাড়া কুড়িল বিশ্বরোড থেকে রামপুরা হয়ে খিলগাঁও-সায়েদাবাদ পর্যন্ত রিকশাসহ অন্যান্য অবৈধ ও অননুমোদিত যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ডিটিসিএর (ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কন্ট্রোল অথরিটি) এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় শনিবার (৬ জুলাই) এক সংবাদ সম্মেলনে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্য ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন কুড়িল থেকে মালিবাগ এবং গাবতলী থেকে আসাদগেট পর্যন্ত প্রধান সড়কে রিকশা চলাচল না করার জন্য রিকশা মালিক, চালকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম। সেই সঙ্গে জানানো হয়, এ বিষয়ে তদারকি করতে মনিটরিং টিম ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে থাকবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা উত্তম কুমার বলেন, ‘ঘোষণা অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন আওতাধীন যেসব সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে সেসব সড়কে মনিটরিং করার জন্য দুইজন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন।’
রাজধানীর উত্তর বাড্ডা মূল সড়কে রিকশা না চলাচল করলেও গলিতে চলছে রিকশা। সেখানে রিকশা চালাচ্ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘ঘোষণা অনুযায়ী মূল সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ থাকায় আমরাও প্রধান সড়কে রিকশা নিয়ে যাইনি। এখন দেখি মালিক সমিতি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসে কী সিদ্ধান্ত নেয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘গলির ভেতরে রিকশা এখন অনেক বেশি সেই অনুযায়ী যাত্রী কম। তাই আমরা যাত্রী কম পাচ্ছি। বড় রাস্তায় দুই ঘণ্টা রিকশা চালালে যে আয় হয় সেই অনুযায়ী সকাল থেকে গলিতে রিকশা চালিয়ে সেই পরিমাণ আয় হয়নি।’
রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে নতুন বাজার যাওয়ার জন্য সড়কে অপেক্ষা করছিলেন মামুনুর রশিদ নামের একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘এই স্বল্প দূরত্বে যাওয়ার জন্য আমরা সাধারণত রিকশায় যাতায়াত করি। কিন্তু আজ রিকশা বন্ধ। লোকাল বাসগুলোতে অতিরিক্ত ভিড়। সাধারণ যাত্রীদের কথা বিবেচনা করে আগে গণপরিবহনের ব্যবস্থা করে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হলে ভালো হতো।’
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন রিকশা মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মমিন আলী বলেন, ‘ঢাকা মহানগরী থেকে অবৈধ, অনিবন্ধিত রিকশা এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা তুলে দেয়া হোক। এতে আমাদের আপত্তি নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালত চললে দরকার হলে আমরাও সহযোগিতা করব।’
তিনি বলেন, ‘সকল সড়কে বৈধ রিকশা চলাচল করার জন্য বাইলেন না করা পর্যন্ত বৈধ রিকশাগুলো চলাচল করতে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছি আমরা।’
সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীর রিকশাচালকদের জীবন-সংগ্রাম, দেশের পণ্য ও নাগরিক পরিবহনে তাদের প্রয়োজনীয়তা, অবদান এবং সংগঠিতকরণ বিষয়ে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস)।
সেখানে বলা হয়, ঢাকা শহরের অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ রিকশায় চড়ে। রাজধানীতে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন (ডিসিসি) একমাত্র রিকশা লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষ, যা ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ৭৯ হাজার ৫৫৪ রিকশা লাইসেন্স ইস্যু করেছে। তবে বর্তমানে ঢাকা শহরের রিকশা প্রকৃত সংখ্যা ১০ লাখেরও অধিক। আনুমানিক ১৫ লাখ রিকশাচালক ও তাদের পরিবার ঢাকা শহরে রিকশার আয়ের ওপর নির্ভরশীল। ঢাকা শহরের সব রিকশাচালক অদক্ষ এবং গ্রামীণ এলাকা থেকে স্থানান্তরিত। তাদের বেশিরভাগই পরিবার ছাড়াই ঢাকায় বাস করে এবং গ্রামের বসতবাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করে। ঢাকা শহরে রিকশার সংখ্যা সীমিত করলে তাদের জীবিকার ঝুঁকি বাড়বে এবং এসব দুর্বল মানুষকে আরও দুর্বল করে তুলবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রিকশাচালকদের মাসিক গড় আয় ১৩ হাজার ৩৮২ টাকা, যার ৬৮ শতাংশ আসে রিকশা চালিয়ে। প্রায় ৯০ ভাগের একমাত্র পেশা রিকশা চালনা, যা এই পেশার ওপর তাদের একমাত্র নির্ভরতার ইঙ্গিত দেয়। রিকশাচালকরা অত্যন্ত দরিদ্র। প্রায় এক-তৃতীয়াংশের কোনো জমি নেই।
ঢাকায় রিকশা চালানো শুরু করার আগে বেশিরভাগই (৫৭.১%) ছিল দিনমজুর, ১৩.৮% যুক্ত ছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়, ১২.১% কৃষিকাজে। রিকশাচালক হিসেবে কাজে আসার পেছনে প্রধান কারণ ছিল অন্য কোনো কর্মসংস্থানের অভাব এবং এই পেশায় আসতে উৎসাহের কারণ ছিল এতে কোনো পুঁজি ও দক্ষতার প্রয়োজন নেই।
ঢাকায় থাকা অবস্থায় ৬২% রিকশা চালায় সপ্তাহে সাতদিন এবং ২৮% চালায় ছয়দিন। এরা দৈনিক ন্যূনতম এক শিফটের জন্য রিকশা চালায়, গড়ে নয় ঘণ্টা প্রতিদিন। ঢাকা শহরের প্রায় সকল রিকশা (৯৬%) চালকের মালিকানাধীন নয়। তারা প্রতিদিন গড়ে ১১১ টাকা পরিশোধ করে ভাড়ায় রিকশা চালায়। ঢাকা শহরের রিকশাচালকদের সর্বনিম্ন উপার্জন দৈনিক প্রায় ৩৬৪.৮ টাকা এবং সর্বোচ্চ উপার্জন দৈনিক প্রায় ৬৬৯.৮ টাকা। নিট গড় আয় দৈনিক প্রায় ৩৭১.৭ টাকা।