ক্রীড়া ডেস্ক: সব ধরনের ক্রিকেট থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলের টেস্ট ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে। এমন এক খবর যে শুনতে হবে তা একদিন আগেও ঘূণাক্ষরে টের পায়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা।
মঙ্গলবার এক জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সাকিব নিষিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো দেশবাসী। প্রার্থনা করতে থাকে এই খবরটা যেন গুঞ্জন হয়, উড়ে যায় গুজবের ন্যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই সত্যি হয়ে আসল। সারা দিন থমথমে অবস্থা বিরাজ করার পর বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যার দিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাকিবের নিষিদ্ধ হওয়ার খবর নিশ্চিত করে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা আইসিসি।
ফিক্সিংয়ের প্রস্তাবের কথা আইসিসির অ্যান্টি করাপশন এন্ড সিকিউরিটি ইউনিটকে (আকসু) না জানানোর কারণে দুই বছরের সাজা গুনতে হচ্ছে বাংলাদেশ অধিনায়ককে। তবে আকসুকে তদন্ত কাজে সহায়তা করায় এক বছর শাস্তি কমিয়ে দিয়েছে আইসিসি। যার ফলে আগামী এক বছর মাঠের বাইরে থাকতে হবে তাকে।
কিন্তু কেন এই সাজা? কিসের ভিত্তিতেই বা সরাসরি নিষিদ্ধ করা হলো সাকিবকে? তার অপরাধের মাত্রাই বা ছিলো কতোটা?- সে সম্পর্কে বিস্তারিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইসিসি।
পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো পুরো প্রতিবেদনটি:
সাকিব আল হাসান একজন ক্রিকেটার যিনি ৫৬ টেস্ট ও ২০৬ ওয়ানডেসহ ৩০০’র বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই সাকিব আইসিসির দুর্নীতি দমন বিষয়ক সভায় সাদরে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি ক্যারিয়ারের শুরুতে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তার কাছে ফিক্সিং করার প্রস্তাব আসলেও তিনি তা ফিরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আইসিসিকে জানিয়ে দেন।
ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার সন্দেহে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ আগস্ট সাকিবকে জিজ্ঞাসাবাদ করে আইসিসির দুর্নীতি দমন বিষয়ক সংস্থা আকসু। সেখানে সাকিব স্বীকার করেন দিপক আগারওয়াল নামক এক জুয়াড়ি তার কাছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল এবং তিনি সেটা গ্রহণ করেননি।
জিজ্ঞাসাবাদে যে যে বিষয়গুলো সাকিব বলেছেন তা হলো-
১. বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ২০১৭ সালের আসরে সাকিব ঢাকা ডায়নামাইটসের একজন খেলোয়াড় ছিলেন।
২. সাকিব জানতেন যে দিপক আগারওয়াল তার ফোন নাম্বার পেয়েছিল তারই এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে। এমনকি সাকিবসহ অন্যান্য খেলোয়াড়েরও ফোন নাম্বার নেয়ার চেষ্টা করেছিল দিপক আগারওয়াল, যারা সেই সময় বিপিএল খেলছিল।
৩. একই বছর নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে দিপক আগারওয়ালের সঙ্গে কথোপকথন করেন সাকিব। এবং সেখানে সাকিবের সঙ্গে সরাসরি দেখা করা ইচ্ছা প্রকাশ করেন দিপক।
৪. জানুয়ারী ২০১৮ সালে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ে ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ত্রিদেশীয় সিরিজ আয়োজন করে বাংলাদেশ। সেই সিরিজেও সাকিবের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে আলাপ করেন দিপক।
৫. ১৯ জানুয়ারী ২০১৮, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হওয়া ম্যাচে সাকিব সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পাওয়ায় তাকে অভিনন্দন জানান দিপক। একই সঙ্গে এটাও লেখেন, ‘আমরা কি এই সিরিজ থেকেই কাজ করব নাকি আইপিএলের জন্য অপেক্ষা করব।’ এখানে কাজ কথাটি ফিক্সিং করার উদ্দেশ্যকে বুঝাচ্ছে।
৬. হোয়াটসঅ্যাপের এই কথোপকথন সাকিব আকসুকে জানায়নি এমনকি সংস্থার সঙ্গে কোনো লোককেও নয়।
৭. ২৩ জানুয়ারী ২০১৮, ফিক্সিং করার উদ্দেশ্যে হোয়াটসঅ্যাপে সাকিবকে আবারো বার্তা পাঠান দিপক। সেখানে তিনি লেখেন, ‘এই সিরিজে কিছু হবে নাকি?’
৮. এসময়ে সাকিব নিশ্চিত হয়ে যান যে দিপক তাকে ফিক্সিং করানোর উদ্দেশ্যে এই কথা গুলো বলছে।
৯. ঘটনা এতদূর এগোনোর পরেও সাকিব এ সম্পর্কে আকসুকে কিছুই জানায়নি।
১০. ২৬ এপ্রিল ২০১৮, আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের হয়ে কিংস এলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ম্যাচ খেলেছিলেন সাকিব।
১১. সেদিন আবারও একটি ম্যাসেজ আসে দিপকের পক্ষ থেকে। ঐ ম্যাচে কে কে খেলছে এবং দলের ভিতরের তথ্য সবকিছু যেন সাকিব তাকে জানায় এবং এর বদলে সাকিবকে ডলার দেয়ার প্রস্তাব দেন দিপক।
১২. সেই ম্যাসেজের পরিপ্রেক্ষিতে জবাব দেন সাকিব। দিপককে তিনি বলেন, ‘আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই আগে।’
১৩. এই ম্যাসেজটি পরে নিজে থেকে ডিলিট করে দেন সাকিব এবং তা আকসুর কাছে স্বীকার করেন তিনি।
১৪. সাকিব স্বীকার করেন যে এই বিষয় নিয়ে তার খুব চিন্তা হচ্ছিল। তিনি মনে করেছিলেন দিপক খুব চালাক লোক। পরক্ষণে তিনি বুঝলেন যে, সে আসলে একজন বুকি।
১৫. ২৬ এপ্রিলের ওই ঘটনার কথা সাকিব আকসুকে জানাননি একথা তিনি স্বীকার করেন।
এই জিজ্ঞাসাবাদের পর সাকিব আকসুর কাছে বলেছেন যে দিপকের কথা মতো কোনো কাজ এবং টাকা বা পুরস্কার গ্রহণ করেননি তিনি। তবে আকসুকে না জানানোর ব্যাপারটা যে তার ভুল ছিল সেটা স্বীকার করেছেন সাকিব।
সাকিবের এই অপরাধ আইসিসির কোড অব কন্ডাক্ট ২.৪.৪ এর আওতায় পড়ে। সেখানে লেখা আছে যে- দুর্নীতি জড়িত কোনো প্রস্তাব পাওয়ার পর সেটা আকসুকে না জানানো এবং জানাতে দেরি করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
সাকিবের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ পাওয়ার পর তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে আইসিসি ও ভারতের ক্রিকেট বোর্ড (যেহেতু তাকে আইপিএলে ফিক্সিং করানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে)। তদন্তের পর প্রমাণ মিলেছে যে সাকিব তিনবার আইসিসির ২.৪.৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন।
আর এজন্য আজ তাকে দুই বছরের জন্য সবধরনের ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ করেছে আইসিসি। আইন অনুযায়ী ২.৪.৪ ধারার এই অপরাধের সাজা হলো সর্বনিম্ন ছয় মাস এবং সর্বোচ্চ ছয় বছর।
এই প্রসঙ্গে সাকিবের যে বিষয়গুলো আইসিসির কাছে নেতিবাচক লেগেছে তা হলো:
১. সাকিবের সঙ্গে দিপক তিনবার যোগাযোগ করার পরও এ বিষয়ে আকসুকে জানাতে ব্যর্থ হন তিনি।
২. দিপক আগারওয়ালের সঙ্গে শুধু একদিনের নয়, অনেক মাসের যোগাযোগ ছিল তার।
৩. দিপক যে সাকিবকে দিয়ে ফিক্সিং করাতে চেয়েছিল তা তার কাছে পানির মতো পরিষ্কার ছিল।
৪. সাকিব একজন অভিজ্ঞ ক্রিকেটার। যিনি এর আগে দুর্নীতিবিরোধী শিক্ষা বিষয়ক অনেক সভায় অংশগ্রহণ করেছেন এবং তিনি তার দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন।
৫. সাকিব বাংলাদেশের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
সাকিবের যে বিষয় গুলো আইসিসির কাছে ইতিবাচক লেগেছে তা হলো:
১. জিজ্ঞাসাবাদের সময় সাকিব খুব ভালোভাবেই আকসুর কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করেছেন।
২. আকসুর কাছে সাকিব নিজের কর্মকান্ডের জন্য অনুশোচনা ও অনুতপ্ত বোধ করেছেন।
৩. সাকিবের শৃঙ্খলার অতীত ইতিহাস।
৪. তার এই অপরাধ ম্যাচের মধ্যে কোনো ক্ষতি করেনি।
৫. তার এই অপরাধ ম্যাচের ফলাফলে কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি।
এইসব দিক বিবেচনা করে তার শাস্তি দুই বছরে নিয়ে আসে আইসিসি। যেখানে পুরো এক বছর সব ধরনের ক্রিকেট থেকে বাইরে থাকতে হবে তাকে। আর এই একবছর যদি সাকিব যদি নিজেকে দুর্নীতি বিষয়ক কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বিরত রাখেন তাহলে তার বাকি এক বছরের সাজা মওকুফ করে দিতে পারে আইসিসি।
আর সেজন্য সাকিবকে যা যা করতে হবে:
১. এই একবছরের মধ্যে সাকিব ক্রিকেটের কোনো আইন ভঙ্গ করতে পারবেন না।
২. আইসিসি দ্বারা আয়োজিত দুর্নীতি দমন শিক্ষা সভায় সাকিবকে মনোযোগ সহকারে অংশগ্রহণ করতে হবে।
আইসিসির এই দাবি গুলোর সঙ্গে সাকিব একমত পোষণ করে তা মেনে নিবেন বলে জানিয়েছেন। তবে এই শাস্তির বিরুদ্ধে কোনো আপিল সাকিব করতে পারবেন না, এমনকি আইসিসিও না। তাই এটা পরিষ্কার যে, এই দুই বছরের জন্য আইসিসি আয়োজিত সবধরনের ক্রিকেট ও ক্রিকেট সম্পর্কিত কর্মকান্ড থেকে সাকিবকে দূরে থাকতে হবে।