বিশ্বজুড়ে চলমান তাবলিগ জামাত আল্লাহর একটি বিধান বাস্তবায়ন করতেই পরিচালিত হচ্ছে। সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ করার আদেশ দিয়েছেন মহান আল্লাহ।
মহান আল্লাহ বিশ্ব মানবতার কল্যাণে মহানবী মুহাম্মদ সা.এর মাধ্যমে যে দীন প্রবর্তন করেছেন তার যথাযথ প্রচার-প্রসার করার নামই হচ্ছে তাবলিগ।
মহান আল্লাহ বিশ্ব মানবতার কল্যাণে মহানবী মুহাম্মদ সা.এর মাধ্যমে যে দীন প্রবর্তন করেছেন তার যথাযথ প্রচার-প্রসার করার নামই হচ্ছে তাবলিগ।
সেই সাথে নবী কারিম সা. কে আল্লাহ তাআলা আদেশ করে ঘোষণা করেছেন,یٰۤاَیُّهَا الرَّسُوۡلُ بَلِّغۡ مَاۤ اُنۡزِلَ اِلَیۡکَ مِنۡ رَّبِّکَ ؕ وَ اِنۡ لَّمۡ تَفۡعَلۡ فَمَا بَلَّغۡتَ رِسَالَتَهٗ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡصِمُکَ مِنَ النَّاسِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ
হে রসুল, তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার নিকট যা নাজিল করা হয়েছে, তা পৌঁছে দাও। আর যদি তুমি না কর তবে তুমি তার রিসালাত পৌঁছালে না। আর আল্লাহ তোমাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফির সম্প্রদায়কে হিদায়াত করেন না। (সুরা মায়েদাহ ৬৬)
তাবলিগ কী ও কেনো
তাবলিগ শব্দের অর্থ পৌঁছে দেয়া। আর তাবলিগ জামাত মানে, প্রচারক দল। বস্তুত মহান আল্লাহ বিশ্ব মানবতার কল্যাণে মহানবী মুহাম্মদ সা.এর মাধ্যমে যে দীন প্রবর্তন করেছেন তার যথাযথ প্রচার-প্রসার করার নামই হচ্ছে তাবলিগ।
তাবলিগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকা। পথভোলা মুমিন কে সঠিক পথে আহ্বান করা। নবী ও সাহাবায়ে কেরামও তাবলিগের কাজ করতেন। মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকতেন। আল্লাহর বিধি-বিধান পালনে উৎসাহিত করতেন।
দীন প্রচারে সাহাবায়ে কেরামের ভূমিকা
দীন প্রচারে সাহাবায়ে কেরাম বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। ইতিহাস পড়লে জানা যায়, সাহাবায়ে কেরাম ইসলাম গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দিতে দীনের ডাকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন আপন ভূমি থেকে দেশ-দেশান্তরে।
দাওয়াত ও জিহাদের পথে ঘরবাড়ি ছেড়ে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম। তাদের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়েই বিশ্বব্যাপী ইসলামের নিশান উড্ডীন হয়েছে।
দীনের পথে বেরিয়ে পড়ে আজীবন সংগ্রাম করে অনেকেই নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন ভিনদেশে। শায়িতও হয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। হযরত উকবা ইবনে নাফে রা.-এর কবর আলজিরিয়ায়।
হযরত আবুল বাকা আনসারী রা.-এর কবর তিউনিসিয়ায়। হযরত রুয়াইফা আনসারী রা.-এর কবর লিবিয়ায়। উত্তর আফ্রিকার দেশে কবর পাওয়া যায়, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. ও হযরত মা’বাদ ইবনে আব্বাস রা.-এর।
হযরত বারা ইবনে মালেক রা.-এর কবর তাসতাবে। হযরত নোমান আলমুযানী রা.-এর কবর নেহাওয়ান্দে। এছাড়াও খোরাসানে কবর রয়েছে হযরত আবু রাফে রা. ও হযরত আবদুর রহমান ইবনে সামুরা রা. এর। ইস্তাম্বুলে, বোহায়রা রোম, হিমসসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে পাওয়া যায় সাহাবাদের কবর। বিখ্যাত সাহাবি, ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন হযরত বিলালে হাবশী রা.-এর কবর পাওয়া যায় দামেশক শহরে। এভাবে কয়েকশ সাহাবার নাম পাওয়া যায়, যারা দীন প্রচারে ছড়িয়ে পড়েছিলেন বিশ্বময়।
বিংশ শতাব্দীতে তাবলিগ জামাত
পৃথিবীর ইতিহাসের বিংশ শতাব্দীতে ইসলাম চার দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে যেতে থাকে। সুফিদের তরবিয়াত খানকায় আর মাদরাসার পাঠ দানও চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর ভারত উপমহাদেশের অবস্থা এর বিপরীত ছিল না। ঠিক এমন একটি মুহূর্তে হিন্দুস্তানে এমন এক মহান মনীষীর আগমন ঘটে; যিনি যুগের স্রোতকে ঘুরিয়ে দেন।
তিনি নবীজির দাওয়াতি মেহনতের আদলে, সাহাবিওয়ালা দাওয়াতের ছাঁচে এমন এক জামাতের সূচনা করেন, যে জামাতের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে কোটিরও বেশি মুসলিম বিশ্বের ১৭০টিরও অধিক দেশে নিজে খরচে আল্লাহর দীনের দাওয়াত পৌঁছানো ও অপর মুসলিম ভাইকে প্রকৃত মুসলিম তৈরিতে নিয়োজিত রয়েছেন।
ইসলামি ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত সুদীর্ঘ এক হাজার বছরেও দেখা যায় না। কোটি কোটি মুসলমানের জীবনে এই জামাত আমূল পরিবর্তন সাধন করেছে। বিশ্ববাসীর কাছে এই মিশন ‘তাবলিগ জামাত’ নামে পরিচিত। আর এই মহান জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলবী রহ.।
এ প্রসিদ্ধ আলেম, মনীষী, সমাজ সংস্কারক ১৮৮৫ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কান্ধলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাঈল। তিনি একজন আল্লাহ্ভীরু আলেম ছিলেন।
তিনি অনেক চেষ্টা করেও সাধারণ মানুষকে দীনের পথে আনতে না পেরে সিদ্ধান্ত নিলেন, মানুষকে ডেকে দীন শেখালে হবে না, বরং মানুষের কাছে গিয়ে তাদের দীন শেখাতে হবে। তাদের ঘর থেকে বের করে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে আসতে হবে। তাদের ইসলাম ও দীনের বুনিয়াদী বিষয়গুলো শিখিয়ে নিষ্ঠাবান (প্র্যাকটিসিং) মুসলিম বানানো হবে।
এ সময় মেওয়াতে ( কোথায় ?) এক বিশাল ইসলাহি ইজতেমার আয়োজন করা হয়। তিনি সেখানে আগমন করেন। শ্রোতাদের বয়ান করেন। তিনি তাদেরকে জামাতবদ্ধ হয়ে আশপাশের গ্রামে বের হওয়ার আহ্বান করেন।
এর এক মাস পর মেওয়াতের পার্শ্ববর্তী গ্রামে প্রথম জামাত বের হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন পরের জুমা সোনা মসজিদে আদায় করবেন। হযরত ইলিয়াস রহ. সেখানে আগমন করেন এবং তাদের গুরুত্বপূর্ণ নসিহত করেন ও দিকনির্দেশনা দিতে থাকেন।
এভাবে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজ শুরু হয় এবং মেওয়াতের অনেক জামাত বিভিন্ন এলাকায় বের হতে থাকে। তিনি প্রতি জুমার নামাজের পর তাদের কারগুজারি ( কারগুজারু কী? সংক্ষেপে বলকে হবে) শুনতেন, নতুন জামাতের পরিকল্পনা করতেন এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিতেন।
১৯৩৮ সালের ১৪ মার্চ হযরত ইলিয়াস, হাজি আব্দুল্লাহ দেহলবী, আব্দুর রহমান, মাওলানা ইহতেশামুল হক কান্ধলবীর সঙ্গে মক্কার সুলতানের সাথে সাক্ষাতের জন্য হেজাজ গমন করেন।
মক্কা মদিনার নেতৃস্থানীয় আলেমরা তাকে দাওয়াত ও তাবলিগের কাজে হেজাজ ভূমিতে ২ বছর অবস্থান করার অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি হিন্দুস্তানে দাওয়াতি কাজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় দেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা পোষণ করেন। হেজাজ থেকে ফিরে এসে তিনি আরও উদ্যমের সাথে তাবলিগের কাজে মনোনিবেশ করেন।
আলীগড়, দিল্লি, বুলন্দশহর, কান্ধলা, সাহারানপুর প্রভৃতি অঞ্চলে তাবলিগের জামাত প্রেরণ শুরু করেন। হযরত ইলিয়াস কান্ধলবি রহ. এর ১৮ বছরের দিন-রাত নিরলস পরিশ্রমে আলোর মুখ দেখতে থাকে তাবলিগ জামাত। হিন্দুস্তানের দূরদূরান্তে জামাত রওনা হওয়া শুরু করে। আলেমরা ও সাধারণের মধ্যে এক দীনি চেতনার আবহ তৈরি হয়।
বিংশ শতাব্দীর এই মহান দাঈ, মুবাল্লিগ ও আলেমে দীন দাওয়াত ও তাবলিগের ময়দানে এক ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি ১২ জুলাই ১৯৪৪ সালে এই নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন।
তার মৃত্যুর পর তাবলিগের হাল ধরেন তারই পুত্র বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ, মাওলানা ইউছুফ রহ.। শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া রহ. তাবলিগ কর্মীদের পাঠ্য হিসেবে ‘তাবলিগে নেসাব’ গ্রন্থসহ বহু গ্রন্থ রচনা করেন।
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের সূচনা:
১৯৪৮ সালে মাওলানা আবদুল আজিজের প্রচেষ্টায় ঢাকায় তাবলিগ জামাতের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর তা দ্রুত সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মাওলানা আবদুল আজিজ ছিলেন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের প্রথম আমির।
১৯৬৫ সালে মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীর মৃত্যুর পর দিল্লিতে মাওলানা এনামুল হাসানকে তাবলিগের আমির করা হয়। সেসময় মাওলানা ইউসুফ কান্ধলভীর বই ‘হায়াতুস সাহাবা’ ও ‘মুন্তাখাবে হাদিস’ তাবলিগের পাঠ্যক্রমে সংযুক্ত করা হয়। এ গ্রন্থগুলো বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে তাবলিগ জামাতে তা’লিম বা পাঠ করা হয়।
তাবলিগের কর্মপন্থা
ক্রমে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে তাবলিগের এ মহান কাজ। মানুষ নবীওয়ালা এ মেহনতে নিজের জানমাল খরচ করে, তিন দিন, এক চিল্লা বা চল্লিশ দিন, তিন চিল্লা বা ১২০ দিন, এক সাল তথা এক বছর সময় অতিবাহিত করতে থাকেন। আবার কেউ কেউ জীবন চিল্লা তথা সারা জীবন তাবলিগের মেহনতে সময় কাটান। আর পথভোলা দীনভোলা বান্দাদের আল্লাহর দিকে ডাকতে থাকেন।