নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকট আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পাকিস্তানে গত সপ্তাহে বহুল কাঙিক্ষত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। তবুও শিগগিরই রাজনৈতিক অচলাবস্থা শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
একদিকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি তথা জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে দেখা দিয়েছে অনিশ্চতা। অন্যদিকে নির্বাচনে অনিয়ম ও ফল কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ ও আন্দোলন শুরু হয়েছে।
পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোটের আন্দোলনের একপর্যায়ে ২০২২ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তোলা অনাস্থা প্রস্তাবের মধ্যদিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতৃত্বাধীন সরকার।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম), ও জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলামের (জেইউআই-এফ) সমর্থনে পিএমএল-এন-নেতৃত্বাধীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন শাহবাজ শরিফ।
মূলত ইমরান খানের সরকারের পতন ও পিএমএল-এন নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরই পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
পিটিআই আগাম নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু শাহবাজ শরিফের সরকার নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। সেই সঙ্গে ইমরান খান ও দলের ওপর চালাতে থাকে ব্যাপক দমন-পীড়ন।
এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যদিয়ে জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হয়। নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলেও যে নির্বাচনের জন্য পিটিআই নেতাকর্মীরা প্রায় দুই বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন সেই পিটিআইকেই শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সব ব্যবস্থা করা হয়।
পিটিআই’র দলীয় নিবন্ধন বাতিল করা হয়। কেড়ে নেয়া তাদের নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও। পিটিআই নেতারা ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিতে বাধ্য হন। শুধু তাই নয়, তারা যাতে নির্বাচনে জিততে না পারে সেজন্য নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ওপর ব্যাপক ধরপাকড় চালানো হয়।
এরপরও গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেল, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি (৯৭টি) আসন পায় কারাবন্দি ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ সমর্থিত প্রার্থীরা। সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ ও নির্বাচনের মাঠে সবরকম সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও ৭৫টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয় নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন)।
৫৪ আসন নিয়ে তৃতীয় হয় পাকিস্তান পিপল’স পার্টি (পিপিপি)। ১৭ আসন পেয়ে চতুর্থ স্থানে উঠে আসে মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম-পি)। কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১৩৪টি আসন না পাওয়ায় জোট সরকার গঠনই অবধারিত হয়ে ওঠে।
ফল প্রকাশের সঙ্গেই সেই লক্ষ্যেই শুরু হয় আলোচনা। দ্বিতীয় অবস্থানে থেকেও সবচেয়ে বেশি তৎপর দেখা যাচ্ছে পিএমএল-এনের নেতাদের। তারা পিটিআই বাদে আর সবগুলো দলের কাছে ছুটছেন। জোট সরকারের এই আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তরুণ রাজনীতিক বিলাওয়াল ভুট্টোর পিপিপি ও খালিদ মকবুল সিদ্দিকির এমকিউএম-পি।
গত মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) রাতে এক ঘোষণায় জানায়, তারা আরও চারটি দলের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের (পিডিএম) আদলে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করবে। ছয় দল মিলে তাদের আসন সংখ্যা হচ্ছে ১৫০টিরও বেশি। যেখানে সরকার গঠনে প্রয়োজন ১৩৪টি।
পিএমএল-এন ও পিপিপি ছাড়া ছয় দলীয় জোটে অন্য দলগুলো হলো মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএমপি), পিএমএল-কিউ, ইস্তেহকাম-ই-পাকিস্তান (আইপিপি) ও বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)।
সরকারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নয়, বরং হচ্ছেন তার ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ। এমনটাই জানিয়েছেন দলের মুখপাত্র মরিয়ম আওরঙ্গজেব। মঙ্গলবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে তিনি বলেন, নওয়াজ শরিফ ছোট ভাই শাহবাজকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য মনোনিত করেছেন।
কিন্তু এভাবে সরকার গঠনের পর তা কতদিন টিকিয়ে রাখা যাবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে। এ ছাড়া দেশটিতে কোনো প্রধানমন্ত্রীরই মেয়াদ পূর্ণ করতে না পারার রেকর্ড তো আছেই।
এদিকে সরকার গঠনের ঘোষণা দিয়েছে পিটিআইও। দলটি তাদের নেতা ওমর আইয়ুবকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সরকার গঠনের জন্য পিটিআই প্রতিষ্ঠাতা কারাবন্দি ইমরান খান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে তার ‘কঠোর অবস্থান’ থেকেও সরে এসেছেন।
পিটিআইর দলীয় সূত্রের বরাত দিয়ে পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ইমরান খান কেন্দ্রে সরকার গঠনের বিষয়ে বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) সঙ্গে আলোচনা করতে রাজি হয়েছেন। সূত্রের খবর, কারাবন্দি ইমরান খান পিপিপির সঙ্গে কথা বলতে ‘প্রস্তুত’।
তবে পাশাপাশি ফল কারচুপির অভিযোগে বিক্ষোভ-আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটির নেতারা। দলটির নেতারা বলছেন, তাদের প্রতি পাকিস্তানি জনগণের একচেটিয়া ম্যান্ডেট বা জনসমর্থন চুরি করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে গত কয়েকদিন ধরে পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে দলটির নেতাকর্মী।
আগামী শনিবারও (১৭ ফেব্রুয়ারি) শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের আহ্বান জানানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) দলটির চেয়ারম্যান গহর আলী খান বলেছেন, ‘ফল কারচুপির বিরুদ্ধে পিটিআই’র আন্দোলন-বিক্ষোভ চলবে।’