আবারও ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল ঢাকা মহানগরী ও এর আশপাশের অঞ্চল। গত রবিবার দুপুর ১২টা ৪৯ মিনিটে সংঘটিত এই ভূকম্পনের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৪.২। ভারতের ভূকম্পন পর্যবেক্ষণকারী সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাইসমোলজি জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল টাঙ্গাইলের সখিপুরে। এ নিয়ে চলতি বছরের সাড়ে আট মাসে বাংলাদেশ ও এর আশপাশে ৩১টি ভূমিকম্প সংঘটিত হয়েছে।
এর মধ্যে সাতটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি দেশের অভ্যন্তরে হয়েছে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা স্বীকার করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ভূমিকম্পের প্রবণতা বেড়েছে। ছোট ছোট ভূমিকম্পকে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত হিসেবেও দেখছেন অনেকে।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে মরক্কোর কয়েকটি শহর রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
উদ্ধার অভিযান চলছে। এরই মধ্যে মৃতের সংখ্যা প্রায় তিন হাজারে পৌঁছেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। বিশ্ব গণমাধ্যমে এটি এখন প্রধান খবর।
বাংলাদেশের মানুষও খবরটি আগ্রহ নিয়ে অনুসরণ করছে। অনেকেই মনে করে, এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়ার এবং সতর্ক হওয়ার অনেক কিছুই রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে আনুমানিক ৭০ হাজার ভবন ধসে পড়বে। যদি তা-ই হয়, অনেক বছরেও সেখানে উদ্ধারকাজ শেষ করা যাবে না। যেভাবে গ্যাসের লাইন, বিদ্যুতের লাইন ছড়িয়ে আছে, তাতে ভূমিকম্পের সঙ্গে সঙ্গেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হতে পারে।
সেই অবস্থায় ধ্বংসস্তূপ থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা প্রায় থাকবেই না। তাঁদের মতে, যেসব ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, সেগুলো যাতে ভূমিকম্প সহনীয় হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। পুরনো যেসব ভবন ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো সম্ভব হলে ভূমিকম্প সহনীয় করে পুনর্র্নিমাণ করতে হবে। তা করা না গেলে সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। নগরীতে অসংখ্য গলি-ঘুপচি রয়েছে, যেসব জায়গায় উদ্ধার অভিযানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি পৌঁছাবে না। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুল্যান্সও পৌঁছাবে না। সেসব জায়গায় রাস্তার সুবিধা তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশে উদ্ধার অভিযানের সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। সেই সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভূমিকম্পের সময় কিভাবে নিজেদের রক্ষার চেষ্টা করতে হবে, বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না। ফলে ভূকম্পন অনুভূত হলে ছোটাছুটি করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে কিংবা বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে অনেকে হতাহত হয়। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতা তৈরিতে বিশেষ কর্মসূচি নিতে হবে।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। একে রোধ করা যাবে না। এমনকি ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেওয়াও সম্ভব নয়। ভৌগোলিক বা অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপ্রবণ একটি এলাকায় অবস্থিত। এখানে অতীতে অনেক বড় ভূমিকম্পের রেকর্ড রয়েছে। আবারও তেমন ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভূমিকম্প থেকে জীবন ও সম্পদ রক্ষায় যথাসম্ভব প্রস্তুতি রাখাই হবে সর্বোত্তম উপায়।
পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী, ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতে (কেন্দ্র) ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর পর ১৮৮৫ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতে আঘাত হানে ৮.৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’। এটা এখন পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশ-সহ বহু দূরের অঞ্চলে। এতে ঢাকায় প্রায় ৪৫০ জন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এর পর দেশে ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল। ১৯৩০ সালের ২ জুলাই ভারতে ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে হয় ৮.৫ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৯৫৪ সালের ২১ মার্চ ভারতের মণিপুরে ৭.৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভারতের অসমে ৬.৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই। ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সিকিমে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে বাংলাদেশেও তীব্র কম্পন অনুভূত হয়। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর, চট্টগ্রামে ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৬। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ৫.২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ওই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালি দ্বীপ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর কাছে ভূমিকম্প হলে তা সাম্প্রতিক কালের অন্য সব বিপর্যয়কে ম্লান করে দেবে।’ বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পের উৎসস্থল থেকে ৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে।
এমন অনেক বহুতল ভবন তৈরি হয়, যেগুলো ভূমিকম্প ছাড়াই হেলে বা ধসে পড়ে। ভূমিকম্প হলে এসব ভবনের অবস্থা কী হবে, তা ভাবতেও কষ্ট হয়। ডোবা-নালা ভরাট করে প্রয়োজনীয় ভিত্তি ছাড়াই ভবন তৈরি করা হয়। ভূমিকম্পের মতো বড় বিপর্যয়ে উদ্ধার তৎপরতা চালানোর মতো প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই বললেই চলে। বড় বড় শহরে অপরিকল্পিতভাবে এমন সব গলি-ঘুপচিতে বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে, যেখানে উদ্ধারকারী যন্ত্রপাতি পৌঁছানো যাবে না। যাদের এসব তদারকি করার কথা ছিল তারা কিছুই করে না। তার ওপর রয়েছে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ এবং মাথার ওপর বিদ্যুতের জঞ্জাল। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বড় কোনো শহরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে ভবনধসে যত মানুষ মারা যাবে, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা যাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে। তার পরও আমাদের নগর সম্প্রসারণে সঠিক পরিকল্পনা নেই।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকার যে মানচিত্র রয়েছে তাতে সিলেট ও চট্টগ্রাম উচ্চ ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চল। ডাউকি ফল্ট লাইনে থাকা সিলেট অঞ্চলে এর আগে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার ওপরে থাকা সেই ভূমিকম্পে সিলেটে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কাজেই সিলেট অঞ্চলে নগর পরিকল্পনায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। যথাযথ পরীক্ষার মাধ্যমে সব ভবনের ভূমিকম্প-প্রতিরোধী সার্টিফিকেট নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি আরো শক্তিশালী করতে হবে।
লেখক: দয়াল কুমার বড়ুয়া, কলামিস্ট ও জাতীয় পার্টি নেতা, সভাপতি, চবি অ্যালামনাই বসুন্ধরা। সংসদ সদস্য প্রার্থী ঢাকা-১৮ আসন।