মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নির্দেশানুসারে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা স্বীকার করেছেন দলত্যাগী কয়েকজন সেনা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে কয়েকজন সেনা প্রথমবার দেশজুড়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনে কিভাবে তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে একজন করপোরালসহ ছয় সেনা ও কয়েকজন ভুক্তভোগীর বক্তব্য নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি তারা সামরিক বাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করেছেন। তারা বর্তমানে জান্তাবিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সাথে রয়েছেন। সাক্ষাৎকার দেয়া কারও প্রকৃত নাম প্রকাশ করা হয়নি।
এমনই এক সেনা মাউং উ বলেন, তারা আমাকে নির্যাতন, লুটপাট, এবং নিরপরাধ লোকদের ধর্ষণ করতে আদেশ দিয়েছিল। আমাকে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল একজন রক্ষী হিসেবে। কিন্তু আমি ছিলাম এমন একটি ব্যাটালিয়নের অংশ যারা ২০২২ সালের মে মাসে একটি বৌদ্ধ আশ্রমে লুকিয়ে থাকা বেসামরিক লোকদের হত্যা করেছিল। আমাদের আদেশ দেয়া হয় পুরুষদের সবাইকে ধরে আনতে এবং তার পর তাদের গুলি করে হত্যা করতে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো যে, আমাদেরকে বয়স্ক মানুষ এবং একজন নারীকেও হত্যা করতে হয়েছিল।
দলচ্যুত এই সেনারা জানান, গত বছর ২৯শে ডিসেম্বর মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলে ইয়াই মিয়েত গ্রামের ওপর চক্কর দিতে থাকে তিনটি হেলিকপ্টার। এতে থাকা সেনাদের ওপর আদেশ ছিল গুলি চালানোর। সেখানে কী ঘটেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন পাঁচ জন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি। তারা আলাদা আলাদাভাবে বিবিসি’র সঙ্গে কথা বলেছেন।
তারা বলছেন, তিনটি দলে ভাগ হয়ে সেনাবাহিনী গ্রামে ঢোকে, এবং নির্বিচারে নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কর্পোরাল আউং বলেন, আদেশ ছিল, যে কাউকে দেখামাত্র গুলি করতে হবে। সেনাদের দেখার পর সেখানকার বাসিন্দারা দৌড়াতে শুরু করে এবং আমরা তাদের গুলি করতে থাকি।
কর্পোরাল আউং স্বীকার করেন যে, তার ইউনিট পাঁচজন লোককে গুলি করে হত্যা করে এবং তাদের কবর দেয়। তিনি বলেন, আমাদের আরও আদেশ দেয়া হয়েছিল যে, গ্রামের সব বড় এবং ভালো বাড়িগুলোতে আগুন লাগানোর। সেনারা গ্রামের পথ দিয়ে যেতে যেতে বাড়িগুলোতে আগুন লাগাচ্ছিল, আর চিৎকার করছিল ‘পোড়াও! পোড়াও!’
কর্পোরাল আউং নিজেও চারটি বাড়িতে আগুন লাগিয়েছেন। অন্য যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয় তারা বলেছেন, প্রায় ৬০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে গ্রামের বেশির ভাগ জায়গাই ছাই হয়ে যায়। গ্রামের বেশির ভাগ লোকই পালিয়ে গিয়েছিল, তবে সবাই নয়। গ্রামের মাঝখানে একটি বাড়িতে লোকজন ছিল।
থিহা বলছেন, তিনি ওই অভিযানের মাত্র পাঁচ মাস আগে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে এসব সেনাদের বলা হয় আংঘার-সিট-থার বা ‘ভাড়া করা সেনা’। সে সময় তাকে ভালো বেতন দেয়া হতো। প্রতি মাসে তিনি পেতেন ২০০,০০০ মিয়ানমার খাট বা প্রায় ১০০ মার্কিন ডলার।
তিনি একটি বাড়িতে আগুন লাগানোর সময় দেখলেন যে, একটি কিশোরী মেয়ে লোহার শিকের পেছনে আটকা পড়েছে। তিনি বলেন, আমি ওই মেয়েটির চিৎকার এখনো ভুলতে পারছি না। এখনো তা আমার কানে বাজছে, আমার মনে তা গেঁথে আছে। তিনি তার ক্যাপ্টেনকে মেয়েটার কথা জানিয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন জবাব দিলেন, আমি তোমাকে বলেছি যাকেই দেখবে সবাইকে মেরে ফেলতে হবে। সুতরাং থিহা ওই ঘরটির মধ্যে আগুনের গোলা ছুড়ে দিলেন। কর্পোরাল আউংও সেখানেই ছিলেন। তিনিও জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হওয়া মেয়েটির আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলেন। থিহা বলেন, এটা শোনা ছিল এক মর্মান্তিক ব্যাপার। বাড়িটা যখন জ্বলছে, তখন আমরা প্রায় ১৫ মিনিট ধরে বার বার তার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম।
বিবিসি ওই মেয়েটির পরিবারকে খুঁজে বের করেছে। পুড়ে ছাই হওয়া বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়েই তারা বিবিসি’র সঙ্গে কথা বলেছেন। মেয়েটির আত্মীয় উ মিন্ট বলেন, মেয়েটির মানসিক সমস্যা ছিল। সেকারণে তার বাবা-মা কাজে যাবার সময় তাকে বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন। সে পালাতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওরা তাকে আটকে রাখে এবং পুড়িয়ে মারে। শুধু এই মেয়েটিই যে এই সেনাদের শিকার হয়েছে তাই নয়।
থিহা বলেন, তিনি অর্থের জন্যই সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাকে যা করতে বাধ্য করা হয়েছিল এবং যে নৃশংসতা তিনি দেখেছেন তাতে তিনি স্তম্ভিত হয়েছেন।
থিয়া ইয়েই মিয়েত এলাকার একদল তরুণী মেয়ের কথা বলেন। তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছিল সেনারা। সেনা কর্মকর্তারা ওই মেয়েদেরকে তার অধীনস্থদের হাতে তুলে দেন। বলেন, তোমাদের যা ইচ্ছা তাই করো। তার পর তারা ওই মেয়েদের ধর্ষণ করে। তবে থিহা বলেন, তিনি নিজে এতে জড়িত হননি। আমরা ওই মেয়েদের মধ্যে দুজনকে খুঁজে বের করি।
পা পা এবং খিন তোয়ে নামের এই দুই তরুণী বলেন, তারা পালানোর চেষ্টা করার সময় রাস্তার ওপর সেনাদের সামনে পড়ে যান। তারা ইয়েই মিয়েত গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন না, সেখানকার একজন দর্জির কাছে এসেছিলেন তারা। সেনাদের তারা বার বার বলেন, তারা পিডিএফের যোদ্ধা নন, এমনকি ওই গ্রামের বাসিন্দাও নন। কিন্তু তাদেরকে তিন রাতের জন্য একটি স্থানীয় স্কুলে বন্দি করে রাখা হয়। প্রতি রাতে তাদের ওপর বারংবার যৌন অত্যাচার চালায় নেশাগ্রস্ত সেনারা, বলেন তারা।
পা পা জানান, সেনারা একটা সারোং দিয়ে আমার চোখ বেঁধে ফেলে, এবং মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর তারা আমার কাপড় খুলে ফেলে এবং আমাকে ধর্ষণ করে। তারা যখন ধর্ষণ করছিল তখনো আমি চিৎকার করছিলাম। তিনি বার বার সেনাদের থামতে বলেন, কিন্তু তারা তার মাথার চারদিকে আঘাত করতে থাকে, বন্দুক উঁচিয়ে হুমকি দেয়। আমাদের এটা মেনে নিতে হয়, কারণ আমরা ভয় পাচ্ছিলাম যে, আমাদের হয়তো মেরে ফেলা হবে।
এই মেয়েরা জানান, তারা এতই আতঙ্কিত ছিলেন যে, তারা নির্যাতনকারীদের দিকে ভালো করে তাকাতেও পারছিলেন না। তবে তারা মনে করতে পারেন যে, তাদের মধ্যে সামরিক ইউনিফর্ম পরা এবং সাদা পোশাকধারী দু’রকম লোকই ছিল।
ধর্ষণের সময় তাদেরকে বলা হয় যে, পিডিএফকে সমর্থন করো বলেই তোমাদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। ইয়েই মিয়েতে সহিংসতায় কমপক্ষে ১০ জন লোক নিহত হয়, এবং তিন দিনের মধ্যে আটজন মেয়েকে ধর্ষণ করা হয় বলে জানা যায়।
যেসব পাশবিক হত্যাকাণ্ডে ভাড়াটে সেনা মাউং উ অংশ নিয়েছিলেন, সেগুলো ঘটেছিল ২০২২ সালের ২ মে, ওহাকে ফো গ্রামে। এই গ্রামটিও সাগাইং অঞ্চলে অবস্থিত। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন, তিনি যে ৩৩ লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনে ছিলেন, তার সদস্যরা একটি বৌদ্ধ আশ্রমের লোকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। ওই আক্রমণের পরপরই বিবিসি যে বিচলিত করার মতো ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ পায়, তার সঙ্গে মাউং উ-র বর্ণনা মিলে যায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, নয়টি মৃতদেহ সারিবদ্ধভাবে পড়ে আছে। যার মধ্যে একজন নারী ও একজন পাকা চুলওয়ালা লোককে পাশাপাশি পড়ে থাকতে দেখা যায়। তারা সবাই সারোং ও টি-শার্ট পরা। ভিডিও থেকে ধারণা করা যায় যে, খুব কাছ থেকে এবং পেছন থেকে তাদের গুলি করা হয়েছিল। যে গ্রামবাসীরা ওই হত্যাকাণ্ড দেখেছেন তাদের সঙ্গেও বিবিসি কথা বলেছে। তারা বয়স্ক লোকটির পাশে থাকা নারীটিকে শনাক্ত করেছেন। তার নাম মা মো মো, এবং তার সঙ্গে ছিল তার সন্তান ও একটি ব্যাগভর্তি সোনার জিনিস। তিনি সেনাদের অনুনয় করছিলেন যাতে তারা তার জিনিসপত্রগুলো না নেয়। লা লা নামের একজন জানান, ওই সময় তিনি ঘটনাস্থলে ছিলেন। সেনারা শেষ পর্যন্ত মো মো-কে হত্যা করে এবং তার জিনিসপত্র লুট করে। নিহত মহিলার শিশু সন্তানটি বেঁচে আছে এবং এখন তার আত্মীয়স্বজনদের কাছে আছে।
লা লা বলছেন, তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন সেনারা ফোনে বড়াই করছে যে, তারা আট-নয়জন লোককে হত্যা করেছে। তারা বলছিল, মানুষ মারাটা খুবই মজার এবং সে দিনটা ছিল তাদের এ পর্যন্ত সবচেয়ে সফল দিন। তিনি বলছেন, তারা গ্রাম ছেড়ে যাবার সময় ‘বিজয়! বিজয়!’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। আরেকজন নারী বলছিলেন, তিনি তার স্বামীকে হত্যার দৃশ্য দেখেছেন। সেনারা প্রথমে তার উরুতে গুলি করে, এবং তাকে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে বলে। তার পর তার নিতম্বে গুলি করে এবং সবশেষে গুলি করে মাথায়। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার স্বামী পিডিএফের সদস্য ছিলেন না।
মাউং উ জানান, তিনি তার কাজের জন্য অনুতপ্ত। সে জন্যই বিবিসি’র কাছে সব বলছেন তিনি। তিনি চান, সবাই জানুক যাতে আর কারও ভাগ্যে এরকম না ঘটে। বিবিসি যে ছয়জন সৈন্যের সঙ্গে কথা বলেছে তারা সবাই মিয়ানমার জুড়ে বাড়িঘর ও গ্রাম পোড়ানোর কথা স্বীকার করে। তারা আভাস দেয় যে, এটা হচ্ছে একটা পরিকল্পিত কৌশল যাতে প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রতি জনসমর্থন নষ্ট করা যায়।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলীর ওপর নজর রাখছে এমন একটি গবেষণা দল হচ্ছে ‘মিয়ানমার উইটনেস’। তারা গত ১০ মাসে একই কায়দায় গ্রাম পুড়িয়ে দেয়ার ২০০টিরও বেশি খবর যাচাই করেছে। তারা বলছে, এ ধরনের অগ্নিসংযোগের মাত্রা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে কমপক্ষে ৪০টি আক্রমণ হয়। এর পর মার্চ ও এপ্রিল মাসে কমপক্ষে ৬৬টি এরকম ঘটনা ঘটে।
মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ‘পোড়ামাটি নীতি’ নেয়ার দৃষ্টান্ত এটিই প্রথম নয়। ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধেও একই নীতি নেয়ার খবর ব্যাপকভাবে পাওয়া গিয়েছিল। মিয়ানমারে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত পার্বত্য এলাকাগুলো অনেক দশক ধরেই এমন আক্রমণের সম্মুখীন। এসব জাতিগোষ্ঠীর যোদ্ধারা অনেকে এখন সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এ গৃহযুদ্ধে পিডিএফকে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সহায়তা দিচ্ছে।
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, সেনাদের বর্ণনা থেকে তাদের যেরকম অবাধে লুটপাট ও হত্যা চালাতে দেয়া হচ্ছে বলে দেখা যাচ্ছে- এ সংস্কৃতি মিয়ানমারে দশকের পর দশক ধরে চলে আসছে। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে এসব নৃশংসতা চালানোর অভিযোগের জন্য কারও জবাবদিহি করার ঘটনা অতি বিরল। তবে সেনাদের দলত্যাগ ও পিডিএফের হাতে নিহত হওয়ার কারণে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে এখন ক্রমশ আরও বেশি করে সেনা ও মিলিশিয়া ভাড়া করতে হচ্ছে। ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে সেনাবাহিনী ও পুলিশ থেকে প্রায় ১০,০০০ লোক দলত্যাগ করেছে।
এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী কর্তৃক বেসামরিক লোকদের টার্গেট করার কথা অস্বীকার করেন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জও মিন তুন। তিনি বলেন, এসব অভিযানের লক্ষ্যবস্তু ছিল আইনসঙ্গত। যারা নিহত হয়েছে তারা ছিল ‘সন্ত্রাসবাদী’। সেনাবাহিনী গ্রাম পোড়াচ্ছে এমন অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি। তার দাবি, পিডিএফই বরং অগ্নিসংযোগ চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত বছর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন নেত্রী অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তারপর থেকে সশস্ত্র বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা করছে জান্তা সরকার।